■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
সারাদেশে মে মাসে নারী ও শিশু হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। ধর্ষণসহ নানা সহিংসতায় চলতি মাসে ৮৬ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা ছিল ৬৯ জন। মে মাসের ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)।
শনিবার (৩১ মে) সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
অন্যদিকে, আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের মাস গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৬১ জন। গত বছরের শেষ ৫ মাসে ৯৬ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৬৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
আসকের তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের মাস আগস্টেই গণপিটুনিতে নিহত হন ২১ জন। পর্যায়ক্রমে সেপ্টেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ১৯, নভেম্বরে ১৪, ডিসেম্বরে ১৪, জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ২০ ও এপ্রিলে ১৮ জন নিহত হন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হন ১২৮ জন। এরমধ্যে গণঅভ্যুত্থানের আগের ৭ মাসে নিহত হন ৩২ জন। আর পরের পাঁচ মাসে গণপিটুনিতে ৯৬ জনের মৃত্যু হয়। অথচ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো বছরে গণপিটুনিতে মারা যান মাত্র ৫১ জন। এর আগের বছর ২০২২ সালে মাত্র ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন ও ২০২০ সালে ৩৫ জন। তথ্যানুযায়ী গত ৯ মাসে শুধুমাত্র গণপিটুনিতে নিহত হওয়াদের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিভাগে গণপিটুনিতে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ১৩, রাজশাহীতে ১৬, চট্টগ্রামে ২৪, বরিশালে ১৬, ময়মনসিংহে ৫, সিলেটে ৫ জন।
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম পর্যায়ে চলে যায় তখনই গণপিটুনির মতো ঘটনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের যখন আইনের আওতায় আনা হয় না তখন এসব ঘটনা আরও বাড়তে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতারোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা তেমন একটা দেখা যায় না। ফলে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ঘটছে, যা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মে মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, যেমন—ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি একই ধারাবাহিকতায় চলছে, আত্মহত্যা বেড়েছে, বেড়েছে হত্যার ঘটনা। পারিবারিক সহিংসতা ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা গত মাসের তুলনায় কিছুটা কমলেও তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ৩৬৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা গত মাসের তুলনায় মাত্র ৬টি বেশি, গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ৩৬২। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৫৯টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৬টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৫টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে গণপিটুনি, হত্যা, আত্মহত্যা, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, সাংবাদিক নির্যাতন, সীমান্তে পুশ ইন, পুলিশের ভয়ে পালাতে গিয়ে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা ও আসামির সংখ্যা বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এমএসএফ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। কারা হেফাজতে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৪টি ঘটনায় শিকার হয়েছেন ৩৫৯ জন। তাদের মধ্যে ৮ জন নিহত এবং ৩৫১ জন আহত হয়েছে।
আহতদের মধ্যে ৯ জন গুলিবিদ্ধ এবং নিহতদের মধ্যে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে একজন কিশোরসহ ছয়জন, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে একজন কিশোর এবং আওয়ামী-জামায়াত সংঘর্ষে জামায়াতের একজন নিহত হয়েছেন। এ মাসে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দুষ্কৃতকারীদের হামলার ২০টি ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১৬ জন আহত ও ৫ জন নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে চারজন বিএনপি এবং একজন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক। এ ছাড়া দুজন আওয়ামী লীগের কর্মী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিহত হন।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির তালিকায় সুনির্দিষ্টভাবে নাম রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭২ জনের। সেই সঙ্গে অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ২ হাজার ৪০০ জন। সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকারের পতন-সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৪২২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেফতার হয়েছেন ৩২ জন এবং সারা দেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে মামলা ও ওয়ারেন্টভুক্ত এবং অন্যান্য মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ২৪ হাজার ৭ শত ৩৩ জন।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ৪১টি ঘটনায় ১০১ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাইবার নিরাপত্তা আইনে এ মাসে চারটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে অভিযুক্ত হয়েছেন সাতজন। মে মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১১টি ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের চারটিসহ মোট ১৫ ঘটনা ঘটেছে।
এমএসএফ প্রতিবেদনে বলেছে, মে মাসে শুরু হওয়া ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্তৃক পুশ ইন কার্যক্রম বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী নাগরিকদের জনজীবনে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। সীমান্তে বিএসএফর ছোড়া গুলিতে দুজন নিহত হয়েছে।
মে মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ৫৫টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। অন্তত ৩৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭ জন নিহত ও ৩৮ জন গুরুতর আহত হয়েছে।