:: অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ::
১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করা হয়। নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল নিছকই একটি সমৃদ্ধ শহর। তবে ভৌগোলিকভাবে নালন্দার অবস্থান সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা সন্দিহান। পালি বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হল, বর্তমান বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকণ্ঠ। বৌদ্ধভিক্ষুদের আবাসস্থলই সংস্কৃত বা পালি ভাষায় ‘বিহার”। অর্থাৎ নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধদের সম্পত্তি, হিন্দুদের নয়। এই বিহার বা মহাবিহারই পরবর্তীকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটদের এবং পরবর্তীকালে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়। গুপ্ত যুগের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে এক বিকাশ ও সমৃদ্ধির যুগ চলেছিল। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে অবশ্য সেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সেই সময় পূর্ব ভারতে পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক বিকাশ ছিল ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
উপমহাদেশের ইতিহাস বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ধর্মের নানামুখী সংঘাত ও সংমিশ্রণের ইতিহাস, একই সঙ্গে আছে শিক্ষা সভ্যতার প্রগতি ও বিলয়ে ভরা ইতিহাস। মধ্যযুগে এই ইতিহাস রচনায় কাণ্ডারি ছিলেন বৌদ্ধ নৃপতিরা। সংসারত্যাগী বুদ্ধ মতবাদের প্রচার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তাঁরা রাজ্য জুড়ে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বৌদ্ধবিহার। এই সব বিহার থেকে কিছু কিছু বিহার পরে অবাধ জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খোলস ছাড়িয়ে হাজার বছর আগে খ্যাতি পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপে।
নালন্দার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমি স্থাপন করে দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ শাসকরা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে গিয়েছিলেন। যে সহজ সরল উত্তরটি আমাদের সামনে ভেসে আসে তা হল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসা। বৌদ্ধশাসন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মণদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাচ্ছিল। ব্রাহ্মণদের মনের ভিতর যে আগুন বংশপরম্পরায় হাজার বছর ধরে গোপনে অতি কষ্টে সংরক্ষিত ছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটায় হিন্দু রাজাদের শাসনামলে এসে। সুযোগ হাতে পেয়েই তাঁরা নিরীহ প্রগতিশীল অহিংসবাদী বৌদ্ধদের উপর নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, দমন ও হত্যা করে উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করে। রাজানুকূল্য বন্ধ করায় ধস নামে এই সব সর্বজনীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। উপরন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের পূর্ণ কর্তত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জোরালো করেছিল দেবদাসী, সহমরণ ও তীব্র জাতি ভেদ প্রথার মতো ঘৃণ্য সব প্রথার।
দেখব নালন্দার সফল অগ্রগতি ও শেষে করুণ পরিণতি নিয়ে। পাল রাজাদের শাসনামলে সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা একই প্রশাসনের অধীনে কাজ করত। প্রয়োজনে শিক্ষকরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেন। খনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সিলমোহর থেকেও এই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়। ‘নালন্দা’ শব্দটি এসেছে ‘নালম’ এবং ‘দা’ থেকে। ‘নালম’ শব্দের অর্থ পদ্ম ফুল, যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। আর ‘দা’ দিয়ে বোঝানো হয়েছে দান করা। তার মানে ‘নালন্দা’ শব্দের অর্থ দাঁড়াল ‘জ্ঞান দানকারী’। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরণের মতো দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলসভাবে। নালন্দা ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছিল তা আজ সঠিক ভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়। কোথাও পাওয়া যায় ৪২৭ সাল, আবার এক জায়গায় পাওয়া ৪৫০ সাল। যাই হোক, ধরে নিই ৪২৭ থেকে ৪৫০ সালের কোনো এক সময়ের মধ্যে এটি স্থাপিত হয়ে থাকবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত বড়গাঁও গ্রামের পাশেই। পাটনার আদি নাম পাটালিপুত্র। ২৩০০ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্র। সম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছে। ‘বিহার’ শব্দের অর্থ ‘বিচরণ’, বৌদ্ধভিক্ষুরা যেখানে অবস্থান করেন বা বিচরণ করেন তাকে বলে বৌদ্ধবিহার। প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার স্বর্ণযুগে এই অঞ্চলে প্রচুর বৌদ্ধবিহারের উপস্থিতি থাকায় পরবর্তীতে ভারতের এই রাজ্যের নামকরণ হয়েছে ‘বিহার’। মৌর্যদের পর বিহার চলে আসে গুপ্তরাজাদের শাসনে। পরে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে বিহার দখল করেন। মোগলদের পর বিহার হাত বদল হয়ে আসে নবাবদের দখলে। নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা বিহার দখল নেয়। ১৯১১ সালে বাংলা থেকে বিহার ও ওড়িশা পৃথক হয়।
নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহাবিহার। যেখানে মূলত বৌদ্ধদর্শনের খুঁটিনাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলত। স্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিকল্প নেই একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতির। যা তৈরি করতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, এ সত্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সেসময়কার নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধভিক্ষু এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক বৌদ্ধশাসকরা। তাঁদের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞানবিজ্ঞানের আরও অনেক শাখা যুক্ত করে তাঁরা নালন্দাকে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। সম্রাট অশোক এখানে একটি বিহার তৈরি করেন। গুপ্তসম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের আমলেই এই মহাবিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাটরা পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দেন।
নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবে। তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখাপড়ার সুযোগ পেত না। এর জন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতার। শিক্ষার্থীরা সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কি না, তা প্রমাণের জন্য প্রবেশদ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষা। সাফল্যের সঙ্গে এই ভর্তি পরীক্ষায় উতরে গেলেই মিলত এখানে বিদ্যালাভের নিশ্চয়তা। পরীক্ষা মোটেই সহজ ছিল না। এতটাই কঠিন ছিল প্রতি দশ জনে মাত্র তিন জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত। ভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০। তাঁদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরও ২,০০০ শিক্ষক। গড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক। কত বড়ো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে তবেই এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের বিদ্যাদান সম্ভব এত শিক্ষক নিয়ে, তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালানোও যেনতেন ব্যাপার ছিল না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারও উপর নির্ভরশীল হতে না হয় সেদিক বিবেচনা করে ২০০ গ্রামকে শুধু মাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী বৌদ্ধশাসকরা। এই সব গ্রামগুলোর অবস্থান শুধু নালন্দার আশেপাশে ছিল না, ছিল সমগ্র বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরি করে গ্রামগুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অন্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্যদ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের জোগান আসত।
বাইরের কোনোপ্রকার উটকো ঝামেলা যাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। ভিতরে ঢোকার জন্য ছিল বিশাল প্রবেশদ্বার। সেসময় যখন-তখন ভারতীয় উপমহাদেশের দেশীয় রাজাদের অন্য রাজ্যে হামলা করা এবং দখল করা ছিল নিত্যনৈমন্তিক ব্যাপার। শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাসাধ্য স্নিগ্ধ ও কোমল রাখতে সমগ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল সুরম্য উদ্যান, যেগুলো সেজে উঠেছিল বিচিত্র ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে। স্নান ও প্রয়োজনীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘিও। ছাত্রদের জন্য ছিল ছাত্রাবাস। জলের সমস্যার জন্য ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকটা মাথায় রেখে প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরি করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়ো। মোট কথা সমগ্র নালন্দা ছিল নিখুঁত পরিকল্পনায় গড়া একটি শিক্ষাস্বর্গ। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা, শিল্পকলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষাব্যাবস্থার উপযোগী আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে। শিক্ষকদের পাঠদান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ। নালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবড়োখেবড়ো শ্বাপদসংকুল দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সুদূর তিব্বত, চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রিস তুরস্ক থেকে ছুটে আসত বিদ্যানুরাগীরা।
ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দূরীকরণ এবং একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাতে তৈরি করা হয়েছিল তিনটি সুবিশাল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের সমস্ত বইই ছিল হাতে লেখা। তখন ছাপার যুগ শুরু হয়নি। বিশাল সংখ্যক কপি-লেখক নিযুক্ত ছিল এইসব বইয়ের অনুলীখনের জন্য। গ্রন্থাগার ভবনগুলো পরিচিত ছিল যথাক্রমে রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে। গ্রন্থাগারের নামকরণ থেকেই অনুমান করা যায় নালন্দার শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের মতে, এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপী, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারী। নির্লোভী এই শিক্ষকরা ভালো করেই জানতেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যাতৃষ্ণায়। তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন।
এত সুবিশাল একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন বঙ্গদেশের সন্তান শীলভদ্র। যিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙের গুরু। প্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আরও একজন বঙ্গীয় স্বনামধন্য পণ্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না-করে উপায় নেই। তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্কর। বর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ নামে পরিচিত। তিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারের শিক্ষকতা ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন বেশ সফলতার সঙ্গে।
ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও যে এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল, তাও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট। কথিত আছে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ১৪টি চতুর্মাস নালন্দায় অতিবাহিত করেছিলেন। আরও বলা হয় যে, গৌতম বুদ্ধও নালন্দার নিকটবর্তী পাবরিক নামক আম্রবনে উপদেশ দান করেছিলেন। বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্যের অন্যতম সারিপুত্ত নালন্দা অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই নির্বাণ লাভ করেন। উক্ত দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতেও একটি গ্রাম হিসাবে নালন্দার অস্তিত্ব ছিল।
গুপ্তযুগেই বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তর হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিশ্বমানের। পালরাজা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কারণ পালরাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। আর নালন্দা ছিল তাঁদেরই অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। একটি সিলমোহর থেকে জানা যায় যে, এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাদিত্য নামে এক রাজা।
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের সঙ্গে নালন্দা মহাবিহারের অবলুপ্তির একটি সম্পর্ক রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থান পর্যটনের সময় হিউয়েন সাঙ লক্ষ করেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাসও পেয়েছিলেন। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার-অনুষ্ঠান ও জাদুবিদ্যা-কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিকদের আবির্ভাব এবং একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের রাজ্যচ্যুতির ঘটনা থেকেই বোঝায় যায় যে, সেই সময় বৌদ্ধধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নৈতিক আঘাত নেমে এসেছিল।
বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার নিরঙ্কুশ অপবাদ বহুল প্রচারিত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ সালে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ জানিয়েছেন ১১০০ সাল। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ সালে। আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। সবচাইতে মজার যে, বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ মে। স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি ১২০৪ সালে বঙ্গে প্রবেশ করেন, সে কীভাবে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করেন? বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে কৌশলে সেনরাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদে হামলা করেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দার ধারেকাছেই যাননি। শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর ‘Antiquity of Chittagong’ প্রবন্ধে লিখেছেন, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ১২০২ সালে। এই তালিকায় নালন্দার উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিক মিনহাজের ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থেও নালন্দা ধ্বংসের উল্লেখ নেই। এই গ্রন্থে বখতিয়ার খিলজির অভিযান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। ১২৩৪-৩৬ সাল নাগাদ, অর্থাৎ বখতিয়ারের (মৃত্যু হয় ১২০৬ সালে) বিহার জয়ের ৩১ বছর পরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু ছিল। সেসময়ে তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী এসে নালন্দা বিহারকে চালু অবস্থাতেই দেখেছেন। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু পড়াশোনা করেছেন।
কিন্তু সবাই যখন বলেন নালন্দা ধ্বংস হয়েছে, তাহলে তো ধ্বংস হয়েছেই। কিন্তু ধ্বংসটা কে করল? অনেকে মনে করেন নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাত। বুদ্ধগয়া ‘গয়া-দর্শন রাজগীর নালন্দাপাওয়াপুরী’ নামক এক পর্যটক সহায়ক পুস্তিকায় বলা হয়েছে — পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ দার্শনিক এবং প্রচারক কুমারভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। বারো বৎসর ব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা (ব্রাহ্মণরা) যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধবিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিস্মাৎ হয়ে যায়। অন্য এক সুত্র তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ বলা হয়েছে উগ্র হিন্দুরা নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে ডি আর পাতিল মনে করেন নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়েছিল শৈব সম্প্রদায়ের মানুষরা। কিন্তু বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘বাঙ্গলার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন — “নালন্দায় লাইব্রেরি কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়।”
P. al. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, “ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরি তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনাকতক তরুণ ভিক্ষু দুজন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল ছিটিয়ে দেয়। তার ফলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ এবং নয়তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।”
এস দাস সম্পাদিত ‘P. al. Jor: History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India’ গ্রন্থখানি পড়ে দেখতে পারেন। পেয়ে যাবেন আরও বিস্ফোরক তথ্য। বুদ্ধপ্রকাশ তাঁর ‘Aspects of Indian History and Civilisation’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন — “নালন্দায় অগ্নিসংযোগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী।” ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর পাটলিপুত্র আক্রমণ করার সময়ই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়। যতদূর জানা যায়, সেই সংখ্যাটা মোট তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ সালে) মিহিরকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। উল্লেখ্য, মিহিরকুলার নেতৃত্বে হানরা ছিল প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা একে পুনর্গঠন করেন।
প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়ের রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে শৈব (শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা মানা) ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কথিত আছে, সেই সময়ে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখ্য, হিন্দু রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে বুদ্ধের অনুরক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব বড়ো একটি যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মান্ধায় প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন’। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন, যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে। হিউয়েন সাঙ এভাবে বর্ণনা করেছেন — “Sasanka-raja, being a believer in heresy, slandered the religion of Buddha and through envy destroyed the convents and cut down the Bodhi tree (at Buddha Gaya), digging it up to the very springs of the earth; but yet he did not get to the bottom of the roots. Then he burnt it with fire and sprinkled it with the juice of sugar-cane, desiring to destroy them entirely, and not leave a trace of it behind. Such was Sasanka’s hatred towards Buddhism.”
এ বিষয়ে ঐতিহাসিক এইচ হিরাস তাঁর ‘The Royal Patrons of the University of Nalanda’ গ্রন্থে কী জানিয়েছেন, একটু দেখি — “Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirkula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.” রাজাদের মধ্যে অন্তর্কলহ, শত্রুতা, হত্যা ও উপাসনালয় ধ্বংস সেসময় খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল না।
বস্তুত এ সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধের অসংখ্য মহাবিহার হয় অগ্নিসংযোগ নয় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সমসাময়িক রচিত গ্রন্থগুলিতে এসব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বৌদ্ধধর্ম’, রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান পতন’ গ্রন্থেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্ৰবংশ উৎখাত করে বাংলায় (অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব) ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মারাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বংশেরই এক রাজা জাতবর্মা। জাতবর্মা ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। জাতবর্মা সোমপুর বৌদ্ধবিহারটি অবরুদ্ধ ও লুণ্ঠন করে এবং অগ্নিসংযোগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন। ওই মহাবিহারের মঠাধ্যক্ষ করুণাশ্রী মিত্রকেও অগ্নিদগ্ধ করে খুন করে। হিন্দুরাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে জাতবর্মা কর্তৃক সোমপুরের মহাবিহার ধ্বংসের ইতিহাস উল্লেখ আছে।
ঐতিহাসিক মিনহাজের বর্ণনায় বিহার ও নদিয়া জয়ের কাহিনি পাওয়া যায়। নালন্দা অভিযান, নালন্দা জয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কোনো ঘটনা বা তথ্য বর্ণিত হয়নি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. আবদুল করিমও সহমত। আবদুল করিম ও সুখময় মুখোপাধ্যায় — এই দুজন গবেষকই বখতিয়ার খলজির উপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন (আবদুল করিম — ‘বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল’, সুখময় মুখোপাধ্যায় — ‘বাংলার ইতিহাস’) এছাড়া শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার — ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকেও বখতিয়ার সম্বন্ধে জানা যায়। মিনহাজের ‘তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে বখতিয়ার সংক্রান্ত তথ্যাবলির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। ইসামি রচিত ‘ফুতুহ উস-সালাতিন’ এবং হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থেও নালন্দা অভিযানের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।
অনেকে মনে করেন, বখতিয়ার দুর্গ ভেবে বৌদ্ধভিক্ষুদের আবাসস্থল ওদন্তপুর মহাবিহার আক্রমণ করেন বিনা বাধায়। দুর্গ দখলের পর উনি লক্ষ করলেন দুর্গের বাসিন্দারা সকলেই মুণ্ডিতমস্তক। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলেন, তাঁরা বৌদ্ধ আর দখলিকৃত দুর্গটি আসলে বৌদ্ধবিহার। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন, ওদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। এ ছাড়া আরও অনেক গবেষক বলেছেন, ওদন্তপুর ধ্বংস হয় ১১৯১-৯৩ সময়কালে। অথচ সুখময় মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, বখতিয়ার বিহার বিজয় করেন ১২০৪ সালে। অতএব বখতিয়ার কর্তৃক উদন্তপুর বা ওদন্তপুর বিহার ধ্বংসের কাহিনিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতেই বাংলার বর্মন-সেনবংশীয় রাজাদের শাসনকালেই বৌদ্ধধর্ম অত্যন্ত বিপন্ন হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে সেনরাজাদের শাসনকালে বৌদ্ধরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ওদন্তপুরে কিছু বৌদ্ধ কোনোরকমে টিকে থাকার কারণ বাংলার পূর্বাঞ্চলে বর্মন-সেনরাজাদের অধিকার তেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বখতিয়ারের সময়কালেই বাংলায় ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে প্রসার ও প্রচার হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অমুসলিম মুসলিম হয়েছিলেন তাঁর সময়েই। তার বড় কারণ সুফি ধর্মপ্রচারক। দক্ষিণবঙ্গ মুসলিম শাসনে আসার বহু বছর আগে একদল সুফি ধর্মপ্রচারক বাস করতেন। সুফিদের প্রভাবেই এখানকার মানুষ ইসলাম ধর্মে চলে আসে। তবে বেশিরভাগ নীচু জাতি ও বৌদ্ধধর্ম থেকেই মানুষ ধর্মান্তরিত হয়। কেবলমাত্র অস্ত্রের আস্ফালনেই নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিজয়ী বাহিনীর ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন আত্মরক্ষার তাগিদে, বাংলার মানুষদের এতটা কাপুরুষ ভাবার কোনো যুক্তি দেখি না। নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের উপর্যুপরি ঘৃণা আর অবজ্ঞাই ধর্মান্তরের মূল কারণ॥”
ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম (প্রথম খণ্ড)॥ [ আরোহী প্রকাশন (কলিকাতা) – মে, ২০২১ । পৃ: ১৩৫- ১৪২