অধিকাংশ সংগঠন ঢাবির হলে রাজনীতির পক্ষে

■ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্যাম্পাস রাজনীতির কাঠামো নির্ধারণে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। বৈঠকে ঢাবির অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন হলভিত্তিক রাজনীতি বজায় রাখার পক্ষে মত দেয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ছাড়া বাকি সব সংগঠন এ প্রস্তাব সমর্থন করে।

রোববার (১০ আগস্ট) দুপুর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এই বৈঠক চলে। এই আলোচনায় অংশ নেয় ১৬টি রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন, যদিও আমন্ত্রিত ছিল ২৩টি।

এদিকে, বৈঠকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপস্থিতির প্রতিবাদে পাঁচটি সংগঠন সভা ত্যাগ করে। এর মধ্যে তিনটি সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), মাহির শাহরিয়ার রেজার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের ছাত্রসংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শুরুতেই ওয়াকআউট করে। পরে বক্তব্য দেওয়ার পর বৈঠক ত্যাগ করে মেঘমল্লার বসুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি অংশ এবং বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী।

ঢাবি প্রশাসন জানায়, আলোচনার লক্ষ্য হল থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা তৈরি করা এবং ডাকসু নির্বাচনে সব সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জানান, গেস্টরুম, গণরুম ও অপরাজনীতির সংস্কৃতি বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা প্রণয়ন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সভা শেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘বিভিন্ন রকম নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার কারণে বিশেষ করে গণরুম, জোর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের নেতিবাচক ধারণা, শঙ্কা, ভীতি এবং ট্রমা আছে। ওই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল যত ছাত্রসংগঠন আছে, ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ২৩টি সংগঠনের সঙ্গে জরুরি ডায়ালগ করছি। যেখান হল পর্যায়ে রাজনীতি কেমন হবে, রাজনীতির রূপটাই কেমন হওয়া উচিত, এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংগঠনগুলো বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে এবং আলোচনা আমরা চালিয়ে যেতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সামনে ডাকসু নির্বাচন আছে। আমরা সবাই মিলে আপনাদের সহযোগিতায় মাঠে নেমেছি এবং এই নির্বাচনে ছাত্রসংগঠনগুলোর পূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। আমরা নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারি এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাতে কোনোভাবেই আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলো মুখোমুখি না হয়।’

নিয়াজ আহমেদ খান আসন্ন ডাকসু নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজনে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান এবং কোনো দমনমূলক ব্যবস্থায় ফেরত না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এ বিষয়ে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, প্রথম বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল মতামত শোনা এবং এ সংলাপ চলমান থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও অনলাইনে মতামত নেব।’

ছাত্রশিবির সাংবাদিদের জানায়, শিক্ষার্থীরা চাইলে হলে রাজনীতি হবে, না চাইলে হবে না।

এদিকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা ও সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ; সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক রায়হানউদ্দিন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএলের সভাপতি গৌতম শীল ও কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান এক যৌথ বিবৃতিতে উপাচার্যের ‘ধৃষ্টতাপূর্ণ’ বক্তব্যের নিন্দা জানান।

বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘বৈঠকের শুরুতে আমরা শিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাই। জবাবে উপাচার্য সব ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতিতে শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে চলার কথা বলেন, যা ঢাবির মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে কলঙ্কিত করেছে।’

তাঁরা আরও বলেন, ‘ঢাবিতে ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা কমিশনের মাধ্যমে ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের অগণতান্ত্রিক প্রচেষ্টারও নিন্দা জানাই। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণকারী সংগঠন হিসেবে আমরা যুদ্ধাপরাধী শিবিরের সঙ্গে কোনো আপস করব না।’

ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, ‘ছাত্রদলের পক্ষ থেকে নিয়মতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামোকে ভিত্তি করে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কমিটি দিয়েছি। কিন্তু একটি গুপ্ত সংগঠনের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার কারণে অনাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। সে জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। সামনে ডাকসু নির্বাচন রয়েছে, সেখানে ছাত্রদলের একটি সাংগঠনিক কাঠামো লাগবে। যার ধারাবাহিকতায় আমরা কমিটি গঠন করেছি। যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের কমিটিকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে, তাহলে আমরা অংশীদারত্বের ভিত্তিতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’

বৈঠকে রাজনীতি থাকা-না থাকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণের কথা জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রস্তাব দিয়েছি, হলে ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, এটির আনুমানিক একটি স্যাম্পল নিয়ে ই-মেইলে ইয়েস-নো ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেন অভিমত নেওয়া হয়। এবং সেই অভিমতের ভিত্তিতে যেন একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেওয়া হয়।’

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘বৈঠকে স্পষ্ট করে বলেছি, আমরা হলে ও অ্যাকাডেমিক এরিয়ায় কোনোরকম রাজনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রম রাখতে দেব না এবং আমরা সেটি চাই না। কেননা, শিক্ষার্থীরা চায় না সেই দাসত্বের জীবন এবং গণরুম-গেস্টরুমের যুগে ফিরে যেতে। শিক্ষার্থীদের সেই সেন্টিমেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হলে এবং অ্যাকাডেমিক এরিয়ায় রাজনীতি না রাখার প্রস্তাব দিয়েছি।’

স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন খালিদ বলেন, ‘স্বল্প সময়ের আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রস্তাবনা আকারে বিভিন্ন সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছে, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু ইনপুট নেবে। সব মিলিয়ে এটি ছিল প্রাথমিক আলোচনা সভা।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *