:: চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ::
সোমালিয়ার জলদস্যুর জিম্মিদশা থেকে মুক্ত বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ২৩ নাবিককে নিয়ে কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় জাহাজটি কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। জাহাজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ নাগরিক নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম নাগরিক নিউজকে জানান, সোমবার (১৩ মে) সন্ধ্যায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করে ২৩ নাবিকসহ জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। এরপর নাবিকদের আরেকটি গ্রুপ পাঠানো হবে। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত নাবিকদের তারা নিয়ে আসবেন তীরে। সদরঘাটের জেটিতেই নাবিকরা নামবেন।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে রয়েছেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. সালেহ আহমদ, মো. শরিফুল ইসলাম ও মো. নুরুদ্দিন।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী নাগরিক নিউজকে বলেন, গত শনিবার জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। জাহাজটি দুবাই থেকে ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে আসে। কুতুবদিয়া চ্যানেলে লাইটারেজ জাহাজ দিয়ে সেগুলোর কিছু অংশ খালাস করা হবে। বাকি চুনাপাথর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এনে খালাস করবে জাহাজটি।
১২ মার্চ বেলা দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। অপহরণের দীর্ঘ এক মাস পর গত ১৩ এপ্রিল সোমালিয়ার সময় রাত ১২টা এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় মুক্তি পায় ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ। এর আগে জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা পৌঁছানো হয় একটি বিশেষ এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে। এই এয়ারক্রাফট থেকে দস্যুদের নির্ধারিত স্থানে তিনটি ব্যাগভর্তি ডলার পৌঁছানো হয়। মুক্তির পর জাহাজটি ২১ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এরপর গত ২৯ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরেক বন্দর মিনা সাকারা থেকে ৫৬ হাজার ৩৯১ টন চুনাপাথর নিয়ে আসা এমভি আবদুল্লাহ কুতুবদিয়ায় নোঙর করল।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এসআর শিপিং জাহাজটি গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। এসআর শিপিংয়ের অধীনে মোট ২৪টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত করা হয় এমভি আবদুল্লাহকে। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। ড্রাফট ১১ মিটারের কিছু বেশি। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেওয়ার আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক।
একই মালিক গ্রুপের এমভি জাহান মনিকে নাবিকসহ ২০১০ সালে জিম্মি করেছিল জলদস্যুরা। সেবারও মুক্তিপণ দিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়।
আকদ করেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছিলেন নাবিক সাজ্জাদ
নিকটাত্মীয় নুপুরের সঙ্গে আকদ করেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছিলেন নাবিক সাজ্জাদ। কথা ছিল, দুবাই থেকে জাহাজে ফেরার পর হবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান।
সব উৎকণ্ঠার অবসান হচ্ছে কাল। সাজ্জাদ ঘরে ফিরবেন আগামীকাল মঙ্গলবার। আর তিনি ফিরলেই বাজবে বিয়ের সানাই। এরই মধ্যে বিয়ের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রেখেছে দুই পরিবারের স্বজনরা। পছন্দ করে রেখেছে বিয়ের ক্লাবও। এখন দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেই শুভ অনুষ্ঠানটা শেষ করতে চায় তারা।
শুধু সাজ্জাদের পরিবার নয়; এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে থাকা অন্যান্য নাবিকদের পরিবারও সাজিয়েছে নানা ছক। সোমবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দর সীমার কুতুবদিয়া পয়েন্টে নোঙর করবে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ। আগামীকাল মঙ্গলবার ঘরে ফিরবে তারা সবাই।
‘গরুর মাংস খুব পছন্দ করেন নুরউদ্দিন। পছন্দ করেন আমার হাতে বানানো কেকও। এই দুই খাবারের অনেক রকম মেন্যু থাকবে মঙ্গলবার রাতে। রান্না করবো বিভিন্ন পদের সেমাই। এবারের ঈদে আমরা সেমাইও রান্না করিনি। ও আসলেই ঈদের আনন্দ করবো। করবো ঈদের শপিংও। ফুল দিয়ে বরণ করবো ওকে। শুনবো দুঃসহ সেইসব দিনের কথাও।’
স্বামী স্টুয়ার্ড নুরউদ্দিন দেশে ফেরার দিন কি করবেন- এমন প্রশ্নে এভাবেই জবাব দিলেন জেনারেল স্টুয়ার্ড নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। নুরউদ্দিন জিম্মি হওয়া সেই ২৩ নাবিকের মধ্যে একজন।
এদিকে সাজ্জাদের মা শামসাদ বেগম বলেন, ‘শুনেছি, মঙ্গলবার ঘরে ফিরবে সাজ্জাদ। অনেকদিন পর আমার ছেলে আমাদের বুকে ফিরবে; তাতেই শোকরিয়া আমার। আর কিছু দরকার নেই। খবর শুনে আমার মনটা শান্ত হয়ে গেল। এবার বাড়ি ফিরলেই জমকালো আয়োজনে ছেলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলবো।’
সাজ্জাদের বড় ভাই মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘সাজ্জাদকে রিসিভ করতে আমরা স্ব-পরিবারে শহর থেকে আনতে যাবো। অনেকদিনের অপেক্ষার পর ভাই আমাদের মাঝে ফিরবে; এতে পরিবারের সবাই অনেক খুশি।’
জাহাজের অয়েল কর্মকর্তা শামসুদ্দিন শিমুলের স্ত্রী ফারজানা সুলতানা বলেন, ‘রোববার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তার বাড়ি ফেরার কথা শুনে সবাই খুবই আনন্দিত। সাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদশার দীর্ঘদিনের কঠিন মূহুর্তের পর তিনি আমাদের মাঝে ফিরবেন; এটা ভাবতেও আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে।’
শিমুলের স্ত্রী আরও বলেন, জাহাজ থেকে নেমে কিভাবে বাড়ি ফিরবেন, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সে সময়টুকু জীবনে স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ আয়োজনের চিন্তা-ভাবনা করছি।