বিক্ষোভের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

জেন-জিদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। নেপালের সচিবালয় থেকে এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সোমবার থেকে নেপালে বিক্ষোভ চলছে। কারফিউ উপেক্ষা করে আজ সকাল থেকে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামেন। তারা নেপালি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও রাজনীতিকের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।

রাজধানী কাঠমান্ডুতে ব্যাপক সহিংস দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের দুই দিন পর মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন কে পি শর্মা অলি। এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছে।

বিক্ষোভ দমনে সরকারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে।

সরকারের ওই দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আজও সকাল থেকে কালঙ্কি, চাপাগাঁও ও কাঠমান্ডুর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। পুলিশ রাজধানীর পার্লামেন্ট ভবনের সামনে থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। পাশাপাশি কাঠমান্ডু, ললিতপুর ও ভাক্তপুর জেলায় আজ সকাল থেকে কারফিউ জারি করা হয়।

আজ দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন কাঠমান্ডুর সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমি। তাঁর হাসপাতালে এখনো ৯০ জনের চিকিৎসা চলছে বলে জানান তিনি।

জেন-জি বিক্ষোভ নামে পরিচিত এই আন্দোলনের একটি প্রধান দাবি ছিল অলির পদত্যাগ। বিক্ষোভকারীদের নেপালির পার্লামেন্ট ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ওলির পদত্যাগের ঘোষণা আসলো।

নেপালের মন্ত্রিসভার মুখপাত্র এবং যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পৃথিবী শুব্বা গুরুং আজ মঙ্গলবার দিনের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা জানান।

রয়টার্সকে পৃথিবী শুব্বা গুরুং বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা আমরা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এগুলো এখন চালু রয়েছে।’

গত সপ্তাহে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন নেপাল সরকার।

নতুন নিয়মনীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে নেপাল সরকার। তবে নিয়ম মানায় টিকটকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল।

বালেন্দ্র শাহকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চায় নেপালের জেন-জি

বালেন্দ্র শাহকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চায় নেপালের জেন-জি

বিক্ষোভের মুখে কে পি শর্মা অলি পদত্যাগের পর নেপালে নতুন প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ চলছে। এরমধ্যে রাজধানী কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিতে দাবি জানাচ্ছে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া জেন-জি। 

মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) কে পি শর্মা দায়িত্ব ছাড়ার পর অনলাইনে জেন-জি বিক্ষোভকারীরা বালেন্দ্রকে দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করছেন।  

বালেন্দ্র শাহ আগে একজন র‌্যাপার ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতিতে এসে কাঠমান্ডুর মেয়র হন তিনি। এখন তার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

আন্দোলনের শুরুতেই বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানান বালেন্দ্র। তবে যেহেতু বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য ২৮ বছরকে বয়স সীমা হিসেবে বেধে দেন। তাই তিনি সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিতে পারেননি।

বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক পোস্টে তিনি লেখেন, “এটি তরুণ প্রজন্মের এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যাদের কাছে হয়তো আমাকেও বয়স্ক মনে হবে। আমি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য এবং চিন্তাভাবনা বুঝতে চাই। রাজনৈতিক দল, নেতা, কর্মী, সাংসদ ও প্রচারকদের এই সমাবেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য বেশি চালাকি করা উচিত নয়।”

তিনি জানান, যদিও স্বশরীরে তিনি আন্দোলনে উপস্থিত হতে পারবেন না। তবে জেন-জির প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন থাকবে।

কে এই বালেন্দ্র শাহ?

বালেন্দ্র শাহ বালেন নামেই বেশি পরিচিত। তিনি কাঠমান্ডুর বর্তমান মেয়র। ১৯৯০ সালে কাঠমান্ডুতে জন্মগ্রহণ করা বালেন্দ্র নেপালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে ভারতের বিশ্বেশ্বরায়া টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

রাজনীতিতে আসার আগে বালেন্দ্র নেপালের আন্ডারগ্রাউন্ড হিপ-হপ জগতের র‌্যাপার এবং গীতিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গানের মাধ্যমে প্রায়শই দুর্নীতি ও বৈষম্যের মতো সামাজিক ইস্যুগুলো তুলে ধরতেন।

২০২২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঠমান্ডুর মেয়র পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বড় দলগুলোর প্রার্থীদের পরাজিত করে ৬১ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন।

নেপালের প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের গুঞ্জন

ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেলও পদত্যাগ করেছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে তিনি ‘প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ’ করেছেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

যদিও পরবর্তীতে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল পদত্যাগ করেছেন—এমন খবরকে ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে তার কার্যালয়। এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্টের দপ্তর বলেছে, চলমান সহিংস বিক্ষোভের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পাউডেলের পদত্যাগের খবর সত্য নয় এবং তিনি এখনও দায়িত্বে রয়েছেন।

দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জেন-জি প্রজন্ম নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভকারীরা কারফিউ অমান্য করে দ্বিতীয় দিনের মতো রাস্তায় অবস্থান করছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের মাঝে মঙ্গলবার সকালের দিকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি।

গত সপ্তাহে কে পি শর্মা অলি নেতৃত্বাধীন সরকার দেশটিতে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পর দেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করেন। সোমবার রাত থেকে সহিংসতা চরম আকার ধারণ করার পর মঙ্গলবার ভোরের দিকে দেশটির সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।

বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দেশটিতে চলমান এই সঙ্কট ক্ষমতাসীন জোট সরকারকে ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়াও কয়েকজন মন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন এবং বড় রাজনৈতিক দলগুলোও জোট সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের কথা ভাবছে।

মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা দেশটির সংসদ ভবনের কিছু অংশে আগুন ধরিয়ে দেন এবং শীর্ষ নেতাদের বাড়িঘরে একযোগে হামলা চালান। হামলার নিশানায় ছিল প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি, প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল, নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহলের বাসভবন।

এছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু দেউবা রানার মালিকানাধীন একটি বেসরকারি স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলটি জ্বলছে এবং বিক্ষোভকারীরা উল্লাস করছেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছিলেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় নেপালের সামরিক বাহিনীর ১২টি উড়োজাহাজে করে মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি উড়োজাহাজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল।

নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচলের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র-খ্যাত ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মঙ্গলবার দুপুরের দিকে সব ধরনের ফ্লাইটের উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিক্ষোভকারীরা ড্রোন, আতশবাজি ও লেজার লাইট দিয়ে বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট থেকে স্থগিত করা হয়েছে। দেশীয় এয়ারলাইনস বুদ্ধ এয়ারসহ অন্য কোম্পানিগুলোও ফ্লাইট বাতিল করে।

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন নেপালের সেনাপ্রধান

জেনারেশন জেড নেতৃত্বাধীন সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেল। আজ মঙ্গলবারের এ ভাষণে তিনি সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবেন বলে জানা গেছে।

সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জেনারেল সিগদেল নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার আহ্বান জানাবেন। উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চলমান বিক্ষোভপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাপ্রধান সরকারের অবস্থান ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কেও জাতিকে জানাবেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *