অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সুশীলা কারকির পা ধরে আশীর্বাদ নেন নেপালের জেন-জি বিপ্লবের নায়ক সুদান গুরুং
■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
নেপালে সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকির সুপারিশে শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কিরণ পোখরেল বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, আগামী বছরের ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
শুক্রবার রাতেই সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুন রেকর্ড গড়েন তিনি। তার নেতৃত্বে ছোট আকারের একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, যার মেয়াদ থাকবে ৬ মাস। এই সময়ে নতুন নির্বাচনের আয়োজনের দায়িত্ব পালন করবে সরকার।
এর আগে নেপালের প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল এবং জেন-জির বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সর্বসম্মতভাবে সুশীলাকে প্রধানমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত হয়।
শুক্রবার রাজধানী কাঠমান্ডুর প্রেসিডেন্ট ভবনে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট রাম সহায় যাদব, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাওয়াত এবং সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল।
নেপালি সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ রেখেছিল। তবে এখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় শনিবার সকাল থেকেই গণপরিবহন স্বাভাবিক হয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘ রুটের বাস চলাচল শুরু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায়ও কিছু যানবাহন গঙ্গাবু বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে গেছে। কাঠমান্ডু উপত্যকায় রাস্তায় যানবাহন ও মানুষের চলাচল উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এদিকে, নেপালের ‘জেনারেশন জেড’ বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২১ বিক্ষোভকারী, ৩ পুলিশ সদস্য, ৯ বন্দি, ১৮ জন অন্যান্য এবং একজন ভারতীয় নারী রয়েছেন। এছাড়া ২৮৪ জন আহত ব্যক্তি বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তথ্য নিশ্চিত করেছে নেপাল পুলিশ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
নেপাল পুলিশের মুখপাত্র ডিআইজি বিনোদ ঘিমিরে জানান, বিক্ষোভ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে মোট ১৪ হাজার ৩০৭ জন বন্দি পালিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. বিকাশ দেবকোটা জানান, এক হাজার ৭৭১ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার তাদের আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়েন কে পি শর্মা অলি। এরপর তিনি গা ঢাকা দেন। ওইদিন বিক্ষোভকারীরা সাবেক দুজন প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালান। এরমধ্যে অর্থমন্ত্রীকে রাস্তায় পেটানোর ঘটনাও ঘটে।
বিক্ষোভ শুরু হয় সরকার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবসহ—নিষিদ্ধ করার পর। গত সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালালে অন্তত ১৯ জন নিহত হন, যার মধ্যে অনেকেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও পুলিশের গুলিতে নিহতদের প্রতি ক্ষোভ ও সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি শীর্ষ নেতার বাড়ি ও সংসদ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন, কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে কিছু মন্ত্রীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।
৭৩ বছর বয়সী সুশীলা কারকি নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এই পদে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতার’ জন্য আলোচিত ছিলেন তিনি।
সুশীলা কারকি ২০১৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নেপালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হন। বিচারক থাকাকালীন তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এ কারণে জেন-জির কাছে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
বিরাটনগরে ৭ জুন ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করা সুশীলা সুশীলা কারকি নেপালের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধান বিচারপতি। ১১ জুলাই ২০১৬ সালে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবিক বিজ্ঞানে স্নাতক ও পরে ভারতীয় বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে আইন বিষয়ে স্নাতক হয়ে ১৯৭৮ সালে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন।
১৯৯০ সালের পঞ্চায়েত শাসনবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি বিরাটনগর জেলে বন্দি হন। বন্দিত্বের অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে ‘কারা’ শীর্ষক একটি উপন্যাস রচনা করেন।
সুশীলা কারকি ২০০৮ সালে নেপাল বার অ্যাসোসিয়েশনে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হন এবং ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাড-হক জাস্টিস হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১০ সালে তার পদ স্থায়ী করা হয়। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি দুর্নীতিবিরোধী কঠোর মনোভাবের জন্য পরিচিত হন।
২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অপসারণ প্রস্তাব আনা হয়, যা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হিসেবে ধরা হয়। তবে জনসাধারণের চাপে এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশনার কারণে প্রক্রিয়াটি স্থগিত করা হয়। এরপর ৬ জুন ২০১৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
অবসর গ্রহণের পর তিনি সমাজকর্ম ও সিভিক আন্দোলনে সক্রিয় হন। গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার পাশাপাশি দুর্নীতি বিরোধী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন। সাবেক মন্ত্রী জয়প্রকাশ গুপ্তাকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা তার উল্লেখযোগ্য অর্জন।
তিনি নেপালি, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় দক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান, চীন, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া ও নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন।
একবার ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুশীলা বলেছিলেন, ভারত নেপালকে অনেক সহায়তা করেছে।
২০০৮ সালে নেপালের দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে পশ্চিমা ধাচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশটিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। কর্মসংস্থানের অভাবে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়াতে ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমায়।