ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক: যুদ্ধ বন্ধে ভূখণ্ড চায় রাশিয়া

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■ 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই সময় সেখানে উপস্থিত হন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও।

সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, তারা বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয়েছেন। কিন্তু কিছু বড় বিষয়ে একমত হতে না পারায় কোনো ধরনের চুক্তি হয়নি।

বৈঠক ও সংবাদ সম্মেলন শেষ করেই ফক্স নিউজকে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প। এতে তিনি জানান, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ হবে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ড তুলে দিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির মাধ্যমে।

ফক্স নিউজের সাংবাদিক ও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সিন হ্যানিটি তখন ভূখণ্ড দেওয়া এবং মার্কিনিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন, “আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি এবং এসব বিষয়ে আমরা অনেকটা সম্মত হয়েছি। আসলে, আমরা অনেক বিষয়ে সম্মত হয়েছি। আমি আপনাকে বলতে পারি, এ বৈঠকটি ছিল উষ্ণ বৈঠক।”

পুতিনকে ‘শক্তিশালী ব্যক্তি’ এবং ‘কঠোর’ হিসেবে অভিহিত করেন ট্রাম্প। তবে তা সত্ত্বেও তাদের বৈঠক বেশ ইতিবাচক হয়েছে বলে জানান তিনি।

ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, যুদ্ধে বন্ধে রাশিয়ার চাহিদা অনুযায়ী ইউক্রেনকে তাদের ভূখণ্ড দিতে হবে। এগুলো মেনে নিয়ে ইউক্রেনকে চুক্তি করতে হবে। তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমরা (যুদ্ধ) শেষের খুব কাছে আছি। এবং দেখুন, ইউক্রেনকে এটি মেনে নিতে হবে।”

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য কোনো উপদেশ আছে কি না? এমন প্রশ্ন ট্রাম্প বলেন, “যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি করুন।”

যুদ্ধবিমানের মহড়া, লাল গালিচায় সংবর্ধনা আর দেয়ালে সাঁটানো স্লোগান ‘শান্তির পথে অগ্রযাত্রা’। গতকাল শুক্রবার এমন রাজকীয় আবহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে আলাস্কায় বৈঠক যে আশায়, তা যেন এখনো অধরা। আকস্মিকভাবে বৈঠক শেষ হয়ে যাওয়া এই বৈঠকের ফলাফল অজানাই রয়ে গেছে।

প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর দুই নেতা যৌথভাবে অগ্রগতির ঘোষণা দিলেও বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে জানা গেল না কী অর্জিত হয়েছে এই দীর্ঘ সময়ের বৈঠকে। কোনো ব্যাখ্যা দেননি এই দুই নেতা।

বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ এই দুই নেতার এই কাজে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই বৈঠকেও কোনো চুক্তি হয়নি। এমনকি বৈঠক শেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়নের কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। বরং ট্রাম্প ‘একটা চুক্তি করতে’ বারবার দায় চাপাচ্ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর।

সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি, আমি বলব বেশির ভাগ বিষয়েই। তবে কিছু বড় বিষয়ে এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, তবে আমরা কিছুটা অগ্রগতি করেছি।’

ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘চুক্তি হওয়ার আগে কোনো চুক্তি বলে কিছু নেই।’

এরপর সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মঞ্চ ত্যাগ করেন দুই নেতা।

জমকালো আয়োজন ও নিরাপত্তার চাকচিক্যে সাজানো এই বৈঠক রয়ে গেল ফলশূন্য। তবে এ বৈঠক মূলত পুতিনকে আবারও বৈশ্বিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে স্বাগত জানানোর এক ইঙ্গিত রেখে গেল।

শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ট্রাম্পের কাজ কতটা কঠিন হতে যাচ্ছে। এলমেনডর্ফ বিমানঘাঁটির টারমাকে যখন দুই প্রেসিডেন্ট একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ইউক্রেনে বাজতে শুরু করে সতর্কবার্তা। খবর আসতে থাকে রুশ ড্রোন ও বিমান হামলার। এতে স্পষ্ট হয়, ট্রাম্প পুতিনকে সম্মান জানানোর আয়োজন করলেও ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে পারেননি।

পুতিন-জেলেনস্কি বৈঠকে থাকবেন ট্রাম্প

ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান, সম্ভাব্য দ্বিতীয় বৈঠকে পুতিন ও জেলেনস্কি দুজনই তাঁকে চান। আলাস্কা বৈঠকের আগেই তিনি বলেছিলেন, এটিই তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য।

ফক্স নিউজকে ট্রাম্প বলেন, ‘ওরা দুজনই আমাকে সেখানে চাইছে, আর আমি থাকব।’

তবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি। বরং ইঙ্গিত দেন, তিনি ‘যাদের প্রয়োজন মনে করেন’ তাদের সঙ্গে রাখবেন, যার মধ্যে জেলেনস্কিও থাকবেন, টেলিফোনে কথা বলবেন এবং বৈঠকের আপডেট দেবেন।

তবে ট্রাম্প-পুতিনের যৌথ উপস্থিতিতে যে একমাত্র পরবর্তী বৈঠকের ইঙ্গিত মেলে, তা ছিল রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্ভাব্য দ্বিতীয় দফা আলোচনা।

ট্রাম্প বলেন, ‘খুব শিগগিরই আপনাদের সঙ্গে আবার কথা হবে, আর সম্ভবত আবার দেখা হবে।’

এর জবাবে ইংরেজিতে পুতিন বলেন, ‘নেক্সট টাইম ইন মস্কো।’ যা কার্যত আলোচনায় জেলেনস্কিকে বাদ দেওয়ার ইঙ্গিতই বহন করে।

আবার কূটনীতির মূল স্রোতে পুতিন

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর ট্রাম্পের লিমোজিনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে পুতিনের হাসিমুখ বলে দেয়, বছরের পর বছর পশ্চিমা বৈরিতার পর, তিনি আবার পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের মাটিতে পা রেখেছেন।

১০ বছর আগে পুতিন শেষবার আমেরিকায় এসেছিলেন এবং তার আগেও কোনো বড় প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে স্বাগত পাননি। ২০২২ সালে তিনি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর বহু পশ্চিমা নেতার কাছে পুতিন ‘সমাজচ্যুত’ হয়ে যান। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ থেকে বহিস্কৃত করা হয় এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তাঁকে গ্রেফতারের হুমকিও দিয়েছিল। আর আঙ্কোরেজ বৈঠকের জন্য আলাস্কাকে বেছে নেওয়ার একটি কারণই ছিল, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সদস্য নয়।

আঙ্কোরেজে পুতিনের বিমান অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘সমাজচ্যুতি’র অবসান ঘটল। লাল গালিচা সংবর্ধনা, যুদ্ধবিমানের মহড়া এবং স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টের করতালি—সব মিলিয়ে ট্রাম্প বুঝিয়ে দিলেন পুতিন আবার কূটনীতির মূল স্রোতে ফিরছেন। তাঁদের হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময়কে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ‘এক ঐতিহাসিক করমর্দন’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

যদিও পুতিন এখনো ইউরোপের অনেক দেশে বহিস্কৃত তবে ট্রাম্পের মতো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী পরিচালনাকারী নেতা তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো কূটনৈতিক বর্জনের প্রচেষ্টা অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে।

এটি আরও স্পষ্ট হলো যখন পুতিন ট্রাম্পের সামরিক গাড়িতে ওঠেন। যা মুহূর্তেই দেখিয়েছে রাশিয়ান নেতার বৈশ্বিক কূটনীতিতে ফেরার প্রতীক। বৈঠক থেকে কোনো বড় অগ্রগতি না হলেও, পুতিনের জন্য এটি ছিল একটি বিজয়।

দুই নেতার একান্ত বৈঠক থেকে প্রতিনিধি সংযোজন

প্রথমে বলা হয়েছিল, বৈঠকটি হবে শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে। কেবল তাদের অনুবাদকেরা থাকবেন। আর কেউ এই বৈঠকে থাকবে না। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত আসে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় দুই নেতার সঙ্গে দুইজন করে প্রতিনিধি থাকবেন।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পুতিনের সঙ্গে একক বৈঠকগুলো রহস্যে ঘেরা থাকত। কেবল অনুবাদক উপস্থিত থাকায়, আলোচনার বিস্তারিত প্রায় সবসময় অজানা থাকত। কখনো কখনো সহযোগীদের জন্যও বোঝা কঠিন হতো যে দুজন নেতা কোনো সমঝোতায় পৌঁছেছেন কি না। জার্মানিতে এমন একটি বৈঠকের পর ট্রাম্প তাঁর অনুবাদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর নোটস ফেলে দিতে।

শুক্রবারের সেশনে দুইজন প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি মার্কো রুবিও এবং মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ যোগ হওয়ায় আগামী দিনে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে যদি রাশিয়া ঘটনার বিবরণ মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন প্রদান করে।

তবে একটি মুহূর্ত ছিল যা কেবল ট্রাম্প ও পুতিনই বলতে পারবেন, বিমানঘাঁটির টারমাক থেকে বৈঠকের কক্ষে প্রেসিডেন্টের লিমোজিনে তাঁদের সংক্ষিপ্ত যাত্রা। গাড়িতে অন্য কেউ ছিল না, না কোনো উপদেষ্টা, না অনুবাদক। কেবল সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা ছিলেন।

বলা যায়, সেই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র তাঁদের দুজনের জানা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *