পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন মার্কিন তিন বিজ্ঞানী

 নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

চলতি বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানীজন ক্লার্ক, মিশেল এইচ. দ্যভোরে এবং জন মার্টিনিস (John Clarke, Michel H Devoret and John M Martinis)। নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং ইলেকট্রিক সার্কিটে এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন গবেষণার জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।’ 

তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নিয়ে নোবেল কৃর্তপক্ষ জানিয়েছে, চিপের ওপর পরিচালিত তাদের পরীক্ষাগুলো কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের কার্যক্রমকে প্রদর্শন করেছে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত এবং সাধারণত ক্ষুদ্রাতীত কণার আচরণগুলো কীভাবে আমাদের পরিচিত বড় আকারের মানব-সৃষ্ট বস্তু বা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে সেটি এ বছরের পদার্থে নোবেল পুরস্কারের বিষয় ছিল।

পুরস্কারপ্রাপ্ত এ তিন বিজ্ঞানী তাদের ধারাবাহিক পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, যে এই ঘটনাটি সম্ভব। তারা এমন একটি অতিপরিবাহী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা তৈরি করেন, যা একটি অবস্থা থেকে সরাসরি অন্য অবস্থায় ‘টানেল’ করে যেতে পারে। বিষয়টি দেখে মনে হয় যেন একটি জিনিস দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে ভেদ করে চলে গেছে।

তারা আরও দেখিয়েছেন যে এই ব্যবস্থাটি নির্দিষ্ট মাত্রার বা সুনির্দিষ্ট ‘ডোজ’-এ শক্তি শোষণ করে এবং বিকিরণ করে। যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।

পদার্থবিজ্ঞানের একটি বড় প্রশ্ন হলো- কোনো সিস্টেম ঠিক কতটা বড় হলে তা কোয়ান্টাম যান্ত্রিক প্রভাব প্রদর্শন করতে পারে? নোবেল বিজয়ীরা একটি ইলেকট্রিকাল সার্কিট নিয়ে পরীক্ষা করে কোয়ান্টাম মেকানিকাল টানেলিং এবং কোয়ান্টাইজড এনার্জি লেভেল প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। 

নোবেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এই আবিষ্কার কোয়ান্টাম প্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্ম বিকাশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে আছে, কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি, কোয়ান্টাম কম্পিউটারস এবং কোয়ান্টাম সেন্সর।

গত বছর মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন হোপফিল্ড ও ব্রিটিশ ক্যানাডিয়ান বিজ্ঞানী জিওফ্রি হিন্টন।

পদার্থ বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল পেয়েছেন আর্থুর আসকিন। ২০১৮ সালে ৯৬ বছর বয়সে তিনি সম্মানজনক এ পদক পান। অপরদিকে ১৯১৫ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পদার্থে নোবেল পেয়ে রেকর্ড গড়েন লরেন্স ব্রেগ। তার চেয়ে কম বয়সে এরপর আর কেউ পদার্থে নোবেল পাননি। আর জন বার্ডিন একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে দুইবার এ ক্যাটাগরিতে নোবেল পেয়েছেন।

নোবেল ইতিহাসে ১৯০১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ১১৮ বার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২২৭ জন বিজ্ঞানী এ পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে মাত্র পাঁচজন নারী—এর মধ্যে রয়েছেন মারি কুরি, যিনি ১৯০৩ সালে প্রথম নারী হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয় করেন।

প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।

উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। প্রথম দিন ঘোষণা করা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল।

ছয়টি বিভাগে ছয় দিন নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা হয় নরওয়ে থেকে। সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্য পুরস্কারগুলো সুইডেন থেকে ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১১৪টি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ২২৭ জন বিজয়ীর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী।

শুরুতে নোবেল বিজয়ীদের প্রায় দেড় লাখ ক্রোনা দেওয়া হতো। বাড়তে বাড়তে ১৯৮১ সালে তা ১০ লাখ ক্রোনা হয়। এরপর পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দ্রুত বাড়ানো হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এর পরিমাণ ১ কোটি ক্রোনা হয়।

সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাড়ানো হয় নোবেল পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী। এ বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা মোট ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা (৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার) পাবেন, যা আগের চেয়ে ১০ লাখ ক্রোনা বেশি। নোবেল ফাউন্ডেশনের তহবিলের উন্নতি হওয়ায় এ বছর পুরস্কারের আর্থিক সম্মানী বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ফাউন্ডেশনের তহবিলে টান পড়ায় ২০১২ সালে পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি ক্রোনা থেকে কমিয়ে ৯০ লাখ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ৯০ লাখ এবং ২০২০ সালে ফের এক কোটিতে উন্নীত করা হয়।

গত এক দশকে ইউরোর বিপরীতে প্রায় ৩০ শতাংশ দর হারিয়েছে সুইডিশ ক্রোনা। ফলে পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ লাখ ক্রোনা বাড়ানো হলেও সুইডেনের বাইরে তা ততটা বাড়বে না।

২০১৩ সালে আর্থিক সম্মানী কমিয়ে ৮০ লাখ ক্রোনা করা হয়। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় এই পুরস্কারের পরিমাণ দাঁড়াত ১২ লাখ ডলার। সেটা বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনা হলেও বিনিময় হারের খেলায় ২০২৪ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ডলারের কম। মুদ্রাস্ফিতি বিবেচনায় নিলে নোবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান খুব একটা বাড়েনি।

বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার মূল্যমান দাঁড়ায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *