গ্রেফতার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাক সেনাপ্রধান

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে গ্রেফতার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে দেশটিতে স্বৈরতন্ত্রের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী আইনে পরিণত হয়েছে। যার মাধ্যমে পাকিস্তানের শীর্ষ আদালতগুলোর পরিচালনা পদ্ধতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।

যারা এই পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলছেন তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশাসনিক কাঠামো প্রদান করবে, একই সাথে আদালতে মামলার জট কমাতেও সাহায্য করবে।

পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দেশটির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেনাবাহিনী। কখনও কখনও তারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, আবার অনেক সময় পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়েছে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এবং জেনারেল জিয়া-উল-হকের মতো সামরিক নেতাদের প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণের ফলে দেশটি একাধিকবার দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

বেসামরিক এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার এই ভারসাম্যকে হাইব্রিড শাসন হিসাবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। সংবিধানের নতুন সংশোধনীকে এখন সেই ভারসাম্য পরিবর্তন হয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে পড়া হিসেবে দেখছেন অনেকে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে দেশটির চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস বা প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান (সিডিএফ) হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর তাঁর মেয়াদ নতুন করে গণনা করা হবে। পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদে তিন বাহিনীর প্রধান নিয়োগ বিষয়ক সংবিধানের সংশোধনী বিল উত্থাপনের পরই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেগুলো পাস হয়।

প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বিতর্কিত ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীতে স্বাক্ষর করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই সংশোধনী বিলগুলো সংসদে তোলা ও পাস করা হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্ট (সংশোধনী) বিল-২০২৫, পাকিস্তান এয়ার ফোর্স (সংশোধনী) বিল-২০২৫ ও পাকিস্তান নেভি (সংশোধনী) বিল-২০২৫ জাতীয় পরিষদে উপস্থাপন করেন। এগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়।

আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার জানান, আর্মি অ্যাক্টে পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হলো চিফ অব আর্মি স্টাফ (সিওএএস) বা সেনাপ্রধানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে মনোনীত করা এবং চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি (সিজেসিএসসি) পদ বিলোপ করা। নতুন কাঠামোয় সিডিএফের মেয়াদ হবে নিয়োগের তারিখ থেকে পাঁচ বছর।

সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, নতুনভাবে সিডিএফ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার দিন থেকেই বর্তমান সেনাপ্রধানের মেয়াদ পুনরায় শুরু হবে। জেনারেল আসিম মুনির সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৭তম সেনাপ্রধান। চলতি বছরের মে মাসে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের পর আসিম মুনিরকে পাঁচ তারকা জেনারেল, অর্থাৎ ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়।

এর আগে ২০২৪ সালের নভেম্বরে সরকার ছয়টি বিল পাস করে, যার মধ্যে তিনটি ছিল সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানদের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। বিরোধীদের ব্যাপক প্রতিবাদের মধ্যেই এই বিলগুলো পাস হয়। বিলগুলোর মূল বিষয়বস্তু ছিল, তিন বাহিনীর প্রধানদের মেয়াদ তিন বছরের বদলে পাঁচ বছর করা। জেনারেল, এয়ার চিফ মার্শাল ও অ্যাডমিরালদের জন্য নির্ধারিত অবসরের বয়সসীমা ৬৪ বছর এই তিন শীর্ষ পদে প্রযোজ্য হবে না। পুনরায় নিয়োগ বা মেয়াদ বৃদ্ধিও পাঁচ বছরের ভিত্তিতে হবে। তবে সিজেসিএসসির মেয়াদ তখনো তিন বছরই রাখা হয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা রানা সানাউল্লাহ খান বলেন, সেনাপ্রধানের মেয়াদ ২০২৭ সালে শেষ হবে এবং তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না।

ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘আমার কাছে, এই সংশোধনীটি সর্বশেষ ইঙ্গিত, সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী। পাকিস্তান এখন আর হাইব্রিড সিস্টেম নয়, বরং একটি পোস্ট-হাইব্রিড সিস্টেমের অভিজ্ঞতা লাভ করছে। আমরা মূলত এমন একটি পরিস্থিতি দেখছি যেখানে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক যতটা সম্ভব ভারসাম্যহীন।’

সংবিধানের এই সর্বশেষ সংশোধনীর ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মুনির এখন পাকিস্তানের নৌ ও বিমান বাহিনীরও তত্ত্বাবধান করবেন। তার ফিল্ড মার্শাল পদবি ও পোশাক আজীবনের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অবসর গ্রহণের পরেও তাকে ‘দায়িত্ব এবং কাজ’ প্রদান করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই সিদ্ধান্তের কারণে, তিনি আজীবন জনপরিসরে কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন। বিলটির সমর্থকরা যুক্তি দিয়েছেন যে, এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড কাঠামোকে আরও স্পষ্ট করে।

সাংবাদিক ও ভাষ্যকার আরিফা নূর বলছেন, ‘বিচার বিভাগ এখন নির্বাহী বিভাগের বেশ অধীনস্থ। সাধারণভাবেই মনে হচ্ছে যে বিচার বিভাগের এখন আপাতত কাজ করার জন্য কোনও স্বাধীন স্থান থাকবে না।’

এই সংশোধনী পাস হওয়ার আগে, সাংবিধানিক মামলার শুনানি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত সুপ্রিম কোর্ট। অনেকেই দাবি করছেন, এর ফলে শুনানির অপেক্ষায় থাকা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার জট তৈরি হয়েছে, কারণ বিচারকদের সাংবিধানিক যুক্তিও শুনতে হচ্ছে।

যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে যে, দুটিকে আলাদা করার ফলে আদালতের কাজের প্রক্রিয়া মসৃণ হয়েছে।

কিছু আইনজীবীর কাছে এই সিদ্ধান্ত কিছুটা আকর্ষণীয় হলেও সুপ্রিম কোর্টের করাচি-ভিত্তিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানে বিচারাধীন বেশিরভাগ মামলা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে নেই।

তার মতে, ‘পরিসংখ্যানগতভাবে, যদি আপনি সত্যিই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে চিন্তিত হতেন, তাহলে আপনি সেই মামলাগুলোর বিষয়ে সংস্কারের ওপর মনোযোগ দিতেন।’

সংশোধনীটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন।

‘যে সংবিধানকে সমুন্নত রাখার এবং রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, তা আর নেই’ – বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ তার পদত্যাগপত্রে বলেছেন। 

বিচারপতি মনসুর আলী শাহ বলছেন, বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ২৭তম সংশোধনী ‘সুপ্রিম কোর্টকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে’।

সর্বশেষ সংশোধনী গত বছর করা ২৬তম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে আইন প্রণেতাদের পাকিস্তানের শীর্ষ বিচারক নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছিল। ইতোমধ্যেই ২৮তম সংশোধনীর জল্পনাও চলছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *