মা-মেয়ে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত গৃহকর্মীর নাম-পরিচয় শনাক্ত

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা ও মেয়ে হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন গৃহকর্মী আয়েশাকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁর প্রকৃত নাম-পরিচয় ও তাঁর স্বামীর নামও জেনেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে গৃহকর্মীকে গ্রেফতার করা যায়নি। কোনো ‘ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট’ না পাওয়ায় তাকে আটক করতে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।

ভবনের ভেতরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর এক নারী স্কুলড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। চার দিন আগে আয়েশা পরিচয় দিয়ে ওই বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেওয়া তরুণী (২০) এই জোড়া খুনে জড়িত বলে সন্দেহ স্বজনদের। ঘটনার পর থেকে ওই তরুণী পলাতক।

‘আয়েশা’কে গ্রেফতার এবং এই জোড়া খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটনে তদন্তে নেমেছে পুলিশ, র‍্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থা। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গৃহকর্মী তাঁর প্রকৃত নাম ও ঠিকানা দেননি। তাঁকে কেউ চিনতেও পারছিলেন না। ঘটনার সময় তাঁর সঙ্গে কোনো মোবাইল ফোনও ছিল না। বাসা থেকে তিনি যে ফোন নিয়ে গেছেন, সেটাও বের হয়েই বন্ধ করে দিয়েছেন। আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সচল না থাকায় ওই বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে কোনদিকে গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

সূত্র বলেছে, ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে ওই তরুণীর চার দিনের মোবাইল ফোনে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সব সময় বোরকা পরে থাকায় ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায়ও তাঁর মুখ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। ফলে তাঁকে শনাক্তে ম্যানুয়ালি কাজ করতে হয়। সম্ভাব্য সব ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁকে শনাক্ত করা হয়।

শিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম প্রতিদিনের মতো গতকাল সকাল ৭টার দিকে কর্মস্থল উত্তরায় যান। তিনি স্ত্রীকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। পরে বেলা ১১টার দিকে বাসায় ফিরে দেখেন, স্ত্রী গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটা অবস্থায় রক্তাক্ত পড়ে আছেন। মেয়ে বাসার ফটকের কাছে গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে ছিল। দ্রুত তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় আজিজুল লিখেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে গৃহকর্মী বাসায় ঢোকেন এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে তার মেয়ের স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এ সময় একটি মুঠোফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ বেশ কিছু মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। তার দাবি, অজ্ঞাত কারণে আসামি স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি বা অন্য ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করে হত্যা করেছেন।

 লাশের সুরতহাল ও আঘাতের ধরন দেখে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, ঘাতক হয় কোনো ‘প্রশিক্ষিত কিলার’, নয়তো অতিরিক্ত ক্ষোভে উন্মত্ত কোনো সাইকোপ্যাথ। সোমবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনার নেপথ্যে প্রকৃত কারণ কী, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে পুলিশ বলছে, সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন নৃশংসতা প্রদর্শন প্রায় অসম্ভব। 

মা ও মেয়ের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে এসেছে লোমহর্ষক তথ্য। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এমন সুরতহাল সাম্প্রতিক সময়ে তারা দেখেননি। নিহত মা লায়লা আফরোজের শরীরে অন্তত ৩০টি জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাম গালে ৩টি, থুতনিতে ৪টি, গলার নিচে ৫টি, বাম হাতে ৩টি, দুই হাতের কব্জিতে মোট ৩টি, বুকের বাম পাশে ৯টি, পেটের বাম পাশে ২টি এবং তলপেটে ১টি গভীর আঘাত রয়েছে। 

অন্যদিকে, মেয়ে নাফিসার গলা ও বুকের দুই পাশসহ শরীরে ৬টি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ময়নাতদন্তকারী সূত্র। সোমবার রাতেই ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। এর একটি সাধারণ সবজি কাটার ছুরি হলেও অন্যটি একটি বিশেষ ধরনের ‘সুইচ গিয়ার’। এটি আঙুলের মধ্যে এমনভাবে আটকে ব্যবহার করা হয়, যাতে আঘাতের সময় হাত থেকে ফসকে না যায়। 

তদন্তকারীদের মতে, এই ধরনের অস্ত্র সচরাচর বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা হয় না। ঘাতক সম্ভবত বাইরে থেকেই পরিকল্পিতভাবে এই অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। অস্ত্রের ধরন এবং ব্যবহারের কায়দা দেখে পুলিশের ধারণা, ঘাতক প্রশিক্ষিত অথবা সে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত (সাইকোপ্যাথ) হয়ে অতিরিক্ত ক্ষোভ থেকে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

জোড়া হত্যার ঘটনায় সোমবার রাতে ‘গৃহকর্মী আয়েশা’কে একমাত্র আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত লায়লা আফরোজের স্বামী স্কুলশিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলার এজাহারে বলা হয়, সোমবার সকাল ৭টার দিকে তিনি উত্তরায় স্কুলে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় স্ত্রীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি বাসায় ফিরে স্ত্রী ও মেয়ের রক্তে ভেজা লাশ দেখেন। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, আয়েশা সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে কাজ করার জন্য বাসায় আসেন এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান।

বাদী এজাহারে আরও বলেন, অজ্ঞাত কারণে গৃহকর্মী আয়েশা তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি অথবা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেছেন।

মোহাম্মদপুরে খুন হওয়া মা-মেয়েকে নিজ এলাকায় দাফন

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হওয়া লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫)-এর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বাদ জোহর নাটোর শহরের গাড়ীখানা কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। 

এর আগে শহরের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মাঠে মা ও মেয়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আহতদের স্বজনসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) ভোরে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাদের মরদেহ নাটোর শহরের বড়গাছা এলাকার পৈতৃক বাড়িতে এসে পৌঁছায়। মা-মেয়ের নিথর দেহ একনজর দেখতে ভোর থেকেই আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভিড় জমান। স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *