:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে আহত হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। রোববার (২১ এপ্রিল) কমলাপুর যাওয়ার জন্য ট্রেনে ওঠার সময় বেলা ১১টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তাকে ভর্তি করা হয়।
মাহাতাব নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ খিলগাঁও রেলগেট এলাকা থেকে কমলাপুর যাওয়ার জন্য একটি ট্রেনে ওঠার সময় পা পিছলে চাকার নিচে পড়ে যান। এতে তার বাম পায়ের সবগুলো আঙুল কাটা পড়ে। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। বর্তমানে জরুরি বিভাগে তার চিকিৎসা চলছে।
আনু মুহাম্মদের বন্ধু নজরুল ইসলাম নাগরিক নিউজকে বলেন, দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া থেকে আজ রোববার সকালে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরছিলেন আনু মুহাম্মদ। খিলগাঁওয়ে পৌঁছানোর পর ট্রেন থেকে নামছিলেন তিনি। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যান। এ সময় ট্রেনটি খুব ধীরগতিতে চলছিল। পিছলে পড়ার পর তাঁর দুই পা ট্রেনের চাকায় নিচে চলে যায়। বেলা ১১টার দিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় তাঁকে।
হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন নাগরিক নিউজকে বলেন, আনু মুহাম্মদের দুই পায়ের পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তাঁর সুচিকিৎসায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকেও চিকিৎসকেরা এসেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক মোশহিতা সুলতানা বলেন, শুক্রবার একটি স্মরণসভায় যোগ দিতে আনু মুহাম্মদ দিনাজপুর গিয়েছিলেন। গতকাল শনিবার সভায় অংশ নিয়ে আজ ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার খবর শুনে তাঁর আত্মীয়স্বজনসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা হাসপাতালে ভিড় করেছেন।
তাঁর ঘনিষ্ঠজন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মো. হারুন অর রশিদ জানান, বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় নিহত কয়লা খনির শ্রমিকদের জন্য দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এক শোকসভা থেকে ট্রেনে করে ফিরছিলেন আনু মোহাম্মদ। নামার সময় দুর্ঘটনা ঘটে।
আহত অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ জানান, ট্রেনটি খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় গতি কমলে ট্রেন থেকে নামছিলেন তিনি। তখন তাঁর বাম পা ফসকে চাকার নিচে চলে যায়।
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, বাম পায়ে আঙুল কাটা পড়েছে। আপাতত ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আঙুলগুলো রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদাউস আহম্মেদ বিশ্বাস বলেন, ‘কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে বিস্তারিত জানতে হাসপাতালে অবস্থান করছি। তবে যতটুক জানা গেছে, খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় একটি ট্রেনের চাকায় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলসহ কিছু অংশ পড়ে গেছে।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, খিলগাঁও রেলগেট থেকে ট্রেনে বাম পায়ের আঙুল কাটা অবস্থায় অধ্যাপক আনু মোহাম্মাদকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে তার প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব।
পুরো নাম আনু মুহাম্মদ আনিসুর রহমান হলেও আনু মুহাম্মদ নামেই অধিক পরিচিত। বাংলাদেশে মার্কসীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি সবচেয়ে পরিচিত লেখক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করেন। তিনি ২০২৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশে শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্য বিরোধী তত্ত্বচর্চা ও লড়াইয়ের একজন সক্রিয় ও সরব মুখ হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
আনু মুহাম্মদ নাম নিয়ে ১৯৭৩ সাল থেকে সাংবাদিক শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিয়মিত লিখতে থাকার মধ্য দিয়ে তিনি লেখক হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল বা জনস্বার্থের বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি লেখালেখির পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চার দফায় দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য (১৯৮৭-২০০০)। তিনি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ও বাংলাদেশ কৃষক ও গ্রামীণ মজুর ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯১ সালে গঠিত ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণে যে গণআদালত বসে সেই গণআদালতের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির কেন্দ্রীয় সংগঠক হিসেবেও কাজ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথবারের মতো যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণীত হয়। যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে বাংলাদেশ হাইকোর্ট ২০০৯ সালে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ণের নির্দেশনা দেন। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত ৮ই মার্চ পর্ষদ এবং ১৯৯৯ সালে ঢাকায় গঠিত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চ’র অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
এছাড়াও তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনসহ যে কোন প্রকার নির্যাতন, শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তিনি ২০০৫-২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি (এরপর থেকে জাতীয় কমিটি বলা হবে) সদস্য সচিব ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সেসময় এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে বহিঃস্কার ও উন্মুখ খনি নিষিদ্ধসহ বিভিন্ন দফা সম্বলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সরকার ও জনগণের মধ্যে যেটি ফুলবাড়ী সমঝোতা চুক্তি নামে পরিচিত। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সেই ফুলবাড়ী সমঝোতা চুক্তিতে জনগণের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর কনোকোফিলিপস এর সাথে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তির প্রতিবাদের জাতীয় কমিটির পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচীতে অংশ নিলে সে সময় নির্মম পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও ২০১১ সালের ২রা জুলাই কনোকোফিলিপসের সাথে দেশবিরোধী চুক্তি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদে জাতীয় কমিটির ডাকা হরতালে অংশ নেয়ার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের আন্দোলন চলাকালে তিনি একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি পান।