নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ কারাগারে

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় গ্রেফতার সাবেক ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে দুদক। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

শুনানিতে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ আদালতকে বলেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আমার কাছে অন্যায় আবদার করতেন। আমি এর প্রতিবাদ করি, সংবাদ সম্মেলন করি। এতে রাগান্বিত হয়ে তিনি আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন।

এদিন বিকেল ৪টার দিকে তাকে দুদকের সাদা একটি মাইক্রোবাসে করে আদালতে হাজির করা হয়। তাকে সরাসরি এজলাসে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। এরপর ৪টা ১৬ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এ সময় তাকে এজলাসে বসার বেঞ্চ থেকে কাঠগড়ায় তোলা হয়।

এরপর ৪টা ২২ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ’র পক্ষে তার আইনজীবী শাহনাজ সুমি জামিন চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, নিয়মবর্হিভূতভাবে তিনি কিছু করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সবকিছুতে একার বিষয় থাকে না। চাইলেই ২ বা ৪ জন টাকা আত্মসাৎ করে নিতে পারে না। সবকিছু ডকুমেন্টেড ব্যাপার। তিনি কিছু আত্মসাৎ করেননি। বিধি, নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সবকিছু করেছেন। তিনি বয়স্ক, অসুস্থ মানুষ। তার জামিনের প্রার্থনা করছি।

দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, দুদকের মামলা হঠাৎ করে হয় না। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান হয়। আসামিও সে বিষয়ে অবগত থাকেন। তিনি মামলার অভিযোগ তুলে ধরে জামিনের বিরোধিতা করেন।

এর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কলিমউল্লাহসহ পাঁচজনকে আসামি করে গত ১৮ জুন দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়।

মামলার অপর আসামিরা হলেন- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রকল্প পরিচালক এ কে এম নূর-উন-নবী, সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, ঠিকাদার মো. আ. সালাম বাচ্চু এবং এম এম, হাবিবুর রহমান।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ, অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপি উপেক্ষা করে নকশা পরিবর্তন করেন। তারা ৩০ কোটি টাকা মূল্যের বেশি চুক্তি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনুমোদন ছাড়া করেন। ঠিকাদারের রানিং বিল থেকে কেটে নেওয়া নিরাপত্তা জামানতকে এফডিআর হিসেবে ব্যাংকে জমা রাখা এবং সেই এফডিআর ঠিকাদারকে লোন দেওয়ার জন্য নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট অনুমোদন তথা গ্যারান্টার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিতে অগ্রিম অর্থ দেওয়ার কোনও আইন না থাকা সত্ত্বেও অগ্রিম বিল দেন এবং অগ্রিম দেওয়া বিল সমন্বয়ের আগেই বিলের বিপরীতে প্রদত্ত ব্যাংক গ্যারান্টিগুলো অবমুক্ত করা হয়। প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ড্রইং বা ডিজাইন না মেনে সরকারি খাতে ক্রয়পদ্ধতির বিধিবহির্ভূতভাবে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্বাভাবিক হারে মূল্য দাখিল বা ফ্রন্ট লোডিং থাকা সত্ত্বেও পিপিআর ২০০৮-এর বিধান অনুযায়ী দরপত্র মূল্যায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

আদালতকে কলিমউল্লাহ, অন্যায় আবদার করতেন দীপু মনি

বিচারকের প্রশ্নের মুখোমুখি হন নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। কত সালে নিয়োগ পান জানতে চান বিচারক। তিনি বলেন, আমাকে প্রথমে বিইউপিতে কো-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন সরকার একদিনের জন্য আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করে। পরবর্তী সময়ে আমাকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর বিচারক জিজ্ঞেস করেন, ২০১৭ সালে? জবাবে তিনি বলেন, হ্যা। বিচারক জানতে চান ক্যাম্পাস কোথায়? কলিমউল্লাহ বলেন, রংপুরে।

পরে বিচারক বলেন, আপনি তো ফুল টাইম ঢাকায় থাকতেন। কলিমউল্লাহ বলেন, না স্যার। আমি ঢাকায় থাকলেও ওইখানে আমার বাসা ছিল। এর জন্য বেতনের ৪০ শতাংশ কেটে নিতো। তখন বিচারক বলেন, চাকরীকালে আপনি তো ১৩৫২ দিনের মধ্যে ১১১৫ দিনই ঢাকায় ছিলেন।

এর জবাবে তিনি বলেন, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি অন্যায় আবদার করতেন। তার কারণে ক্যাম্পাসে যেতাম না। আমি এই তার এসব আবদারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করি। তিনি রাগান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন। প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা ভার্সিটির স্বার্থে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই প্রথম, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শিক্ষামন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ কারণে দীপু মনি আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন।

তখন বিচারক বলেন, আপনি ও আপনার মা কোনও এক নিয়োগ বোর্ডে একই সঙ্গে ছিলেন? তখন তিনি বলেন, তিনি (তার মা) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ডিজি ছিলেন। তিনি একজন সার্টিফায়েড সসিওলজিস্ট। এজন্য তাকে সরকার নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করেন।

পাল্টা প্রশ্নে বিচারক জানতে চান, আপনি কি একই সঙ্গে ভিসি, বিভাগীয় প্রধান ও ডিন ছিলেন? জবাবে কলিমউল্লাহ বলেন, আমিই প্রথম নয়। আগের ভিসির ধারাবাহিকতা রক্ষায় এসব দায়িত্বে ছিলাম৷ উপযুক্ত লোক না থাকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে এ দায়িত্বে থাকতে হয়েছে।

বিচারক জানতে চান, চার বছরে উন্নয়ন খাতে কোনও টাকা পেয়েছেন? তখন কলিমউল্লাহ বলেন, আমার আগের ভিসি নুর নবীর সময় ৯৯ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ চলমান রেখেছি। আর নকশা পরিবর্তনের অভিযোগ আগের ভিসির বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটাই প্রকল্প বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প। আমি এসে নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছি।

তখন বিচারক বলেন, নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্যের অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধেই। জবাবে কলিমউল্লাহ বলেন, নো। নেভার, নেভার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এসব অপবাদ ছড়িয়েছেন।

এ সময় দুদক প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি বলেন, উনি ১৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন। আমরা তো তাকে টকশোতে দেখেছি। তখন কলিমউল্লাহ উত্তর দেন, সেটা তো রাতে।

পরে বিচারক দুদক প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান— তার বিরুদ্ধে অন্য মামলা আছে কি না? আদালতকে দুদক জানায়, এই মামলায় আছে। এখন নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের তদন্ত শুরু হবে।

সে সময় দুদকের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, অভিযোগ আগে তদন্ত হোক।

কলিমউল্লাহর উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, আপনি কী করেছেন, সেটা আলিমুল গায়েব জানেন আর আপনি জানেন। কিছুদিন পর দুদক জানবে। এরপর মানুষ জানবে।

তখন কলিমউল্লাহ বলেন, গত মাসের ১৮ তারিখে মামলার বিষয়টি ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। আমি ভেবেছিলাম, দুদক থেকে আমাকে তলব করা হবে। আজ সকালে আকস্মিকভাবে নাস্তার পর ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে, আপত্তি করিনি।

পরে বিচারক বলেন, আপনি আপত্তি করবেন কেন? কবরেও একা যেতে হবে, জেলখানায়ও একা যেতে হয়। কেউ সঙ্গে যায় না। দুর্নীতি যারা করছেন তারা জেলে পচছেন। আর দুর্নীতির টাকায় তার আত্মীয়রা অনেকে বিলাসি জীবনযাপন করছেন, বিদেশ ভ্রমণ করছেন।

এরপর কলিমউল্লাহ বলেন, মাননীয় আদালত, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি। আমি একজন কমিশন্ড অফিসার, গ্রেড-১ অফিসার। তখন বিচারক বলেন, আপাতত আপনাকে জেলে যেতে হচ্ছে। আর জেল কোড ও আপনার অবস্থান অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট পাবেন, সেটা আমি আদেশ দিচ্ছি।

পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *