■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ক্রেন দিয়ে ভাঙা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ৩২ নম্বরের আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়।
সৈয়দ রিফাত নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের ধ্বংসস্তূপের প্রমাণ রেখে দেওয়ার জন্য এই ইট রাখলাম। এরপরও যদি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের কেউ ফিরে আসার কথা বলে, এই ইট তার কপালে যাবে।
৩২ নম্বরের আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। রাত ১১টায় ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভাঙার জন্য বুলডোজারের জন্য বাড়িটির সামনে অপেক্ষা করছিলেন ছাত্র-জনতা। এ সময় ৩২ নম্বরের পাশের রাস্তা দিয়ে একটি ক্রেন যাচ্ছিল। বুলডোজার ভেবে আটকানো হয় ক্রেনটি। পরে সেই ক্রেন নিয়ে আসা হয় বাড়িটির সামনে। এ সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তাঁরা। সেই ক্রেন দিয়েই বাড়িটি ভাঙার শুরু করা হয়।
এর আগে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লাইভে বক্তব্য দেওয়ার ঘোষণা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশকে ‘ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি’ মুক্ত করার ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোক এসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো শুরু করে।
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক আইডিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’
এরপর রাত ৮টার দিকে লোকজন স্লোগান দিয়ে ৩২ নম্বরের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তাঁরা বাড়ির সর্বত্র উঠে ভাঙচুর চালানো শুরু করেন।
সরেজমিন দেখা যায়, বাসাটির গেইটসহ বিভিন্ন ভাঙা অংশ পড়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ম্যুরাল ভাঙতে দেখা যায় একজনকে। অনেকেই বিভিন্ন তলায় ও ভবনের ছাদে উঠেছেন; লাঠিসোঁটার পাশাপাশি কারও কারও হাতে জাতীয় পতাকা।
সরেজমিন দেখা গেছে, পেছনের ওই ছয়তলা ভবনে শত শত মানুষ ঢুকছেন। কেউ কেউ ভেতর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। আর ভবনটির ভেতর থেকে হাতুড়ির আঘাতে নানা কিছু ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ওই ভবন থেকে যেসব জিনিস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে বেশির ভাগই শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা কিংবা পরিবারের সদস্যদের লেখা বই রয়েছে। কেউ এসব বইয়ের কার্টন নিয়ে বের হচ্ছিলেন, কারও কারও হাতে ছিল কয়েকটি করে বই।
এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভলিউম-৩’, ‘জনসমুদ্রে এক মহামানব’, ‘জাতির জনক ও শেখ রাসেল’ ইত্যাদি।
ভেতর থেকে ভাঙারি পণ্য হিসেবে বিক্রয় করা যাবে—এমন স্টিল, লোহা ও কাঠের নানা কাঠামো ভেঙে যে যাঁর মতো নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। স্টিল ও লোহার কাঠামো ভবন থেকে ভেঙে ভেঙে কয়েকজনকে নিচে ফেলতে দেখা যায়। নিচে থাকা কয়েকজন এগুলো রিকশায় করে অন্যত্র সরিয়ে নেন। যাঁরা এসব লোহালক্কড় নিচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।
আল আমিন নামের এক ব্যক্তি লোহার কিছু কাঠামো নিচ্ছিলেন। এসব নিয়ে কী করবেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই, বিক্রি করে দিমু। সেই টাকায় ভালোমন্দ খামু। মুরগি পাইলে মুরগি, গরুর মাংস পাইলে গরুর মাংস কিনে খামু। এই ছাড়া আর কিছুই না।’
ভাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এই মহিলা নিজের জিদ দিয়ে দলটাকে একেবারে শেষ কইরা দিয়া গেল।’
সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটির সামনে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। শত শত মানুষ ওই বাড়ির সামনে আসছিলেন। ভিডিও করছিলেন। ছবি তুলছিলেন। তবে মাঝে ঘণ্টাখানেক সময় ভাঙার কাজ সাময়িক বন্ধ ছিল।
শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার নিন্দা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা স্থাপনায় ভাঙচুর ও হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা হুমকিস্বরূপ।
সংস্থাটি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আইন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে আসক এ কথা বলেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, সবার আইনের সমান আশ্রয় লাভ, আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ও আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। অন্যথায় সরকারের ব্যর্থতা বলে প্রতীয়মান হওয়ার অভিযোগ ওঠার সুযোগ থাকে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের চেতনার প্রতি আসক শ্রদ্ধাশীল এবং বলিষ্ঠভাবেই সমর্থন করে। আসক মনে করে, চলমান তাণ্ডবগুলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এ ছাড়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা হুমকিস্বরূপ।
আসক সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আইন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানায়। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের কার্যক্রম আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরিচালনা করা উচিত বলে আসক মনে করে।
হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের বহিঃপ্রকাশ বলছে সরকার
ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িতে ভাঙচুর, আগুন ও লুটপাটের ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
গত ৬ মাসে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে কোনো ধরনের আক্রমণ, ধংসযজ্ঞ হয়নি জানিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যের দুটি অংশ ঘিরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
বিবৃতি অনুসারে তার একটি হচ্ছে, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন শেখ হাসিনা তাদের অপমান, অবমাননা করেছেন। শহীদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক শেখ হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা করেছেন।”
দ্বিতীয়টি, “শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালে যে সুরে কথা বলতেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও তিনি একই হুমকি-ধামকির সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে, অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি দিয়েছেন।”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে, সে ক্ষততে শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলছেন। তার এই সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও জনগণের জানমালের রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার যথাযথ চেষ্টা করছে।”
মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন ওয়ারেন্টভুক্ত অভিযুক্ত শেখ হাসিনা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব বলে মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকার আশা করে, ভারত যেন তার ভূখণ্ডকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে—এমন কাজে ব্যবহৃত না হতে না এবং শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না।