কোটা বাতিল: দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

সরকারি চাকরিতে বেতন কাঠামোর ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত বহালে উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগ অবরোধ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। 

বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শত শত শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কলাভবন, ভিসি চত্বর ও টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান শুরু করলে পুরো এলাকা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।

এ সময় তাদের ‘কোটা প্রথা বাতিল চাই বাতিল চাই’; ‘আঠারোর পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে’; ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’; ‘৫২-এর হাতিয়ার গর্জে উঠো আরেকবার’; ‘ছাত্র সমাজের একশন ডাইরেক্ট একশন’; ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘মেধা যার, চাকরি তার’; ‘সারা বাংলায় খবর দে কোটাপ্রথা কবর দে’; ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘জেগেছে রে জেগেছে ছাত্রসমাজ জেগেছে’; ‘সংবিধানের মূলকথা সুযোগের সমতা’; ‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে’; ‘৭১-এর হাতিয়ার গর্জে উঠো আরেকবার’; ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ ইত্যাদি সংবলিত স্লোগান দিতে দেখা যায়।

আন্দোলনকারীরা জানান, ২০১৮ সালে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে অন্যায্য ও অযৌক্তিক ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরি (নবম-ত্রয়োদশ গ্রেড) থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে পরিপত্র জারি করে। কোটাবৈষম্য নিরসন ছিল শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রাণের দাবি। গত ছয় বছর ধরে সেই অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছে এবং একটি মেধাভিত্তিক দক্ষ প্রশাসন তৈরিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রস্তুত করছে।

গত ৫ জুন ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্র বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। এই রায়ের বিপক্ষে সেদিন থেকেই আন্দোলনে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল বুধবারও রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। সেই কর্মসূচি থেকে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা আসে।

কুবি শিক্ষার্থীদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ

কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আদর্শ সদর উপজেলার কোটবাড়ী এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে সড়ক অবরোধ করে তারা আন্দোলন শুরু করে। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী দুই লেনে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।

এর আগে সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্ত্বরে আবাসিক হল ও মেসের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়। এরপর পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্বরোড অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে তারা পুলিশি বাঁধার মুখে পড়েন। পরে জাদুঘর সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে কোটবাড়ি বিশ্বরোডে অবস্থান নেন। 

সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটাপদ্ধতি পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এ অবরোধ হয়। চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, কয়েকটি দাবিতে তাঁরা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছে। ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল সাপেক্ষে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী বিএম সুমন বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কোটা বৈষম্য থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ করেছিল। কিন্তু আজকের এই সোনার বাংলায় এখনও পাকিস্তানিদের দোসর রয়ে গেছে। শোষণকারী পাকিস্তানিদের বংশধর হচ্ছে বর্তমান এই আমলারা। এই ৫৬ শতাংশ কোটা বিলোপ চাই। স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র মরে যেতে দেব না।

এ বিষয়ে কুমিল্লা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন বলেন, মহাসড়ক এক মিনিট অবরোধ হলেও সরকারের কাছে বার্তা চলে যায়। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর এ দাবির বিষয়ে সরকার অবগত। মানুষের ভোগান্তি নিরসনে শিক্ষার্থীরা যেন স্থান ত্যাগ করেন৷ সে ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্পূর্ণ একমত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বাংলাদেশের ব্যস্ততম মহাসড়ক। তাই প্রশাসন চেষ্টা করছে যেন দ্রুত তারা স্থান ত্যাগ করে।

কোটা বাতিল: দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে তারা মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। 

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ রাবি শিক্ষার্থীদের

বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে, দুপুর ১২টার দিকে তারা মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। 

এসময় শিক্ষার্থীদের ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘সংগ্রাম না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’ সহ বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার প্রদর্শন এবং কোটাবিরোধী এসব স্লোগান দিতে শোনা যায়।

৪ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো- 

১. ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে। পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।

২. যাদের কোটা আছে জীবদ্দশায় একবারই কোটা ব্যবহার করতে পারবে।

৩. প্রতি ১০ বছর পর পর জনসুমারির সঙ্গে অর্থনৈতিক সমীক্ষা করতে হবে যাতে আমরা বুঝতে পারি কোটার প্রয়োজনীয়তা কেমন এবং কোটার মূল্যায়ন করা।

৪. দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আন্দোলনে আসা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ আজাদ বলেন, বাংলাদেশে চাকরির বাজারে ৫৬ শতাংশ কোটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ। এ কোটার কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে যায়। আমরা চাই স্বাধীনতার এত বছর পর একটি সুন্দর ও বৈষম্যমূলক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হোক। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *