:: লালমনিরহাট প্রতিনিধি ::
শিশু ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগে ২৩ বছরের কারাজীবন পার করা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রেখা খাতুন (৪৪) দীর্ঘ সময়ে অজান্তেই সবকিছু হারিয়েছেন রেখা। এক বোন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। মা-বাবা, ভাইবোনসহ একে একে মারা গেছেন পরিবারের ২৫ জন। স্বামীও অন্যত্র বিয়ে করেছেন। বাবার বাড়িটিও বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাঁর।
শিশু ধর্ষণের মামলায় দুই পুরুষ আসামিকে সহযোগিতা করার দায়ে ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর গ্রেফতার হন রেখা খাতুন। আদালতের রায়ে লালমনিরহাট কারাগারে ছিলেন। দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগ শেষে সম্প্রতি মুক্ত হন।
২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রেখা খাতুনসহ তিন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। একই মামলায় দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। কিন্তু কারাগারে রয়ে যান শুধু রেখা খাতুন। দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগ করতে হয় তাঁকে।
রেখার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর শেষ হয়। এরপরও জরিমানার ১ লাখ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাঁকে আরও তিন বছর কারাগারে থাকতে হতো। সে হিসেবে ২০২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত লালমনিরহাট জেলা কারাগারে থাকার কথা তাঁর।
রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়।
৯ এপ্রিল সকালে জেল থেকে বেরিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন রেখা খাতুন। তাঁর দাবি, শিশু ধর্ষণের ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। অথচ ধর্ষণে সহায়তার করার অপরাধে কারাগারে কেটে গেল ২৩টি বছর। এখন জানতে পেরেছেন ছোট বোন ছাড়া পরিবারের কেউ নেই। এখন কোথায় গিয়ে উঠবেন কিছুই জানেন না।
কারাগারে যাওয়ার আগের ও পরের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রেখা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জেলে থাকার সময় আমার মা, বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ আমার ২৫ আত্মীয় মারা গেছেন। আমি জেলে গেলে আমার স্বামী কোরবান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করে এখন কোথায় আছেন তা কেউ বলতে পারে না। আমার বাবার বাড়িটা ধরলা নদীতে বিলীন হয়েছে। স্বামীর অবর্তমানে বাবার বাড়িতে জীবনের বাকি দিনগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার আশাও নেই। আমি এখন কোথায় যাব!’
রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়। ধরলা নদীতে বাবার বাড়ির ভিটা বিলীন হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে রেখার বাবা ফজলু রহমান মারা গেছেন। আর মা নূরনাহার বেগম মারা যান ১২ বছর আগে। তাঁদের কবরও গ্রামের বাড়িতে হয়নি। পাশের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের কবির মামুদ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাঁদের। ওই গ্রামে রেখার ছোট বোন টুম্পা বেগমের বিয়ে হয়েছে। কারামুক্তির পর টুম্পার শ্বশুরবাড়িতেই আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন রেখা।
দারিদ্র্যের কারণে ১৩-১৪ বছর বয়সে রেখা খাতুনের বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী কোরবান আলী তখন ৩৪ বছরের যুবক। পেশায় দিনমজুর। বিয়ের পরও দু-তিন বছর বাবার বাড়িতে থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে স্বামীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। রেখা ও তাঁর স্বামী লালমনিরহাট শহরের খোচাবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি লালমনিরহাট শহরের নর্থ বেঙ্গল মোড় এলাকার দুলাল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন ও লালমনিরহাট শহরের কুড়াটারি গ্রামের ভোলা মিয়ার ছেলে ফরিদ হোসেন। রায় ঘোষণার সময় ফরিদ হোসেন পলাতক ছিলেন। পরে গ্রেফতার হন। ওই দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। এর মধ্যে আলমগীর হোসেন দাম্পত্য কলহের জেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ফরিদ হোসেন লালমনিরহাট শহরের একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। অথচ তাঁদের সহায়তার অপরাধে দণ্ডিত রেখা খাতুন কারাভোগ করলেন দীর্ঘ ২৩ বছর!
নারী অধিকার সংগঠক ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘রেখা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে তাঁর জীবনের গল্প আমরা শুনেছি। সেই হিসেবেই লালমনিরহাট–৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মুক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা করেছি।’
রেখার জরিমানার টাকার অঙ্ক ১ লাখ টাকা হলেও তিনি অতিরিক্ত চার মাস ছয় দিন সাজা ভোগ করায় জরিমানা থেকে ১০ হাজার টাকা মওকুফ হয়ে যায়। এর বাইরে রেখা কারাগারে অবস্থানকালে শ্রমের বিপরীতে উপার্জন করেন ১৫ হাজার টাকা। ওই টাকা সমন্বয় হয়ে পরিশোধ করতে হতো ৭৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পৌরসভার মেয়র সম্মিলিতভাবে ওই টাকা দিয়েছেন। ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট জেল সুপার ওমর ফারুক বলেন, কারাগারে রেখা খাতুনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি হস্তশিল্পের কাজ করে উপার্জন করতে পারবেন। রেখা ২৩ বছর ৪ মাস ৫ দিন লালমনিরহাট জেলে কাটিয়েছেন। ওই নারী অত্যন্ত ভালো মানুষ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাঁকে সহায়তা করলে হস্তশিল্পের কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।
লালমনিরহাট–৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান বলেন, ‘রেখা খাতুনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সবকিছু শুনেই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁকে কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’