:: আশিকুজ্জামান টুলু ::
কিছু সুগন্ধি মোমবাতি নিভে যাওয়ার পরও অনেকটা সময় জুড়ে সুগন্ধ বিলিয়ে যায় । ঠিক তেমন কিছু শিল্পীর প্রস্থানের পর রয়ে যায় তার প্রতি ভালোলাগার রেশ । তাদের মধ্যে দুয়েকজনকে নিয়ে জীবপদ্দশায় বাড়াবাড়ি না থাকলেও প্রস্থানের পর মায়ার টানটা অনেক বেড়ে যায়, কেন যেন মনটা কেঁদে ওঠে । সেরকম একজন শিল্পী আমাদের খালিদ । ও বেচে থাকতে ওকে নিয়ে কারও তেমন মাথা ব্যাথা বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও মৃত্যুর পর প্রচণ্ড ভাবে বোঝা গিয়েছে কিছু শ্রোতা তাকে মনের মণিকোঠায় কোথায় উঠিয়ে রেখেছিল, কিভাবে ভালোবেসেছিল ।
শেষের দিকে খালিদকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতাম যেখানেই যাচ্ছে তাকে কিছু মানুষ গান গাইতে বলছে এবং ও কোন যন্ত্র ছাড়া কোন প্রস্তুতি ছাড়া কোন ভুমিকা ছাড়াই গাওয়া শুরু করে দিচ্ছে । এটা কিসের লক্ষন জানেন?
যখন একজন মানুষের ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অর্থাৎ বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা লোপ পায় এবং পৃথিবী থেকে নতুন কিছু পাওয়ার আর আগ্রহ থাকেনা এবং সে বুঝে যায় পৃথিবী খুব নশ্বর একটি সাময়িক অবস্থান, তখন সে নিজেকে বাতাসে উড়িয়ে দেয়, ভাসিয়ে দেয়, মনে মনে ভাবে “নিয়ে যাক আমার এই দেহ যেখানে নিতে চায়”। এই অনুভবটাকে আমাদের কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে কারন আমরা যারা বস্তুবাদী, তারা তো ঐ মানুষটার চিন্তার লেয়ারে পৌঁছতে পারিনি । আমরা ওকে কটাক্ষ করি, পাগল বলি, হাসাহাসি করি, কেউ কেউ চাই ওর প্রস্থান । বুঝতে পারিনা ওর মন কোথায় অবস্থান করছে ।
এরকম আরেকজনকে আমি দেখছিলাম যে কিনা প্রস্থানের আগে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো আর কেউ গাইতে বললে, গান শোনাতে শুরু করতো সরল শিশুর মতো । সে ছিল আমাদের হ্যাপি আখন্দ । নীলয়কেও আমার একই কাতারের মনে হয় কিংবা লাকি ভাই কিংবা আইয়ুব বাচ্চু কিংবা আমাদের প্রাণপ্রিয় আজম ভাই, এরা যেন কেমন এক ধরনের মানুষ, যাদের জন্য আত্মার ভেতর থেকে মায়া জন্মায়, ভালোবাসা জন্মায়, আদর জন্মায় । এদেরকেই বলা হয় জাত শিল্পী যারা কোনদিনও কারও কাছে প্রচারের জন্য যায় না কিংবা কারও সাহায্য আশা করেনা । যদিও শিল্পী মাত্রই এরকম অর্থাৎ একজন প্রকৃত শিল্পী তার অন্তর্নিহিত প্রাইডের কারনে কারও কাছে হাত পাতেনা, কারও কাছে প্রচার প্রসারের জন্য যায় না, কাউকে অনুরোধ করেনা তার হয়ে কিছু করে দিতে, কারও পিছে ঘুরেনা কোন কাজের জন্য, কারও অফিসে গিয়ে বসে থাকেনা কিছু পাওয়ার আশায়, সে একা একা জীবন কাটায় তার নিজস্ব বলয়ে ।
টগবগে ব্রুস উইলিসের ডেমেনশিয়া ধরা পড়ে ২০২২ । বর্তমানে উনি আর কিছু মনে করতে পারেন না এবং কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন । চিন্তা করা যায় যিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে টান টান উত্তেজনায় রাখতেন ঘন্টার পর ঘন্টা, হলিউডে দাপিয়ে বেড়াতেন, তিনি এখন আর কথা বলতে পারেন না, সব কিছু ভুলে গিয়েছেন মাত্র দুই বছরের ব্যাবধানে । কি অদ্ভুত একটা জীবন, কি অদ্ভুত এই প্রকৃতি । এখনি আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে আবার এখনি ডুবিয়ে দেয় অন্ধকার অমানিশায়, ঠিক যেমন ক’দিন আগেই খালিদ ইন্টারভিউ দিচ্ছিল তানভীরের অনুষ্ঠানে অথচ আজ সে কোথায় কেউ জানেনা ।
মানুষের সাময়িক ব্যাস্ততার কারনে অনেক সময় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় মিস করে এবং সেই মিস করা বিষয়টা আর কোনদিনও ফিরে আসেনা, সারাজীবনের জন্য মিসড থেকে যায় । ২০১৯ এ ঢাকা গিয়ে ভেবেছিলাম আলাউদ্দিন ভাইয়ের সাথে দেখা করবো, কথাও হলো অমুক দিন বিকেলে যাচ্ছি । কল করে জানলাম আলাউদ্দিন ভাই ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন, ফিরতে ২ ঘন্টা সময় লাগবে, ভাবলাম আজ বাদ দেই, কাল যাবো দেখা করতে । জানেনে? সেই কাল আর কোনদিনও আসলো না, আমি ক’দিন পরে ফিরে এলাম প্রবাসে এবং আর কোনদিনও দেখা হলোনা, আলাউদ্দিন ভাই চলে গেলেন । একই ঘটনা ঘটেছে বাচ্চু ভাইয়ের ব্যাপারে এবং নিলয়ের ব্যাপারে । আশ্চর্যজনক ভাবে একেবারে একই ঘটনা ঘটলো খালিদের সাথেও । ঠিক বছর দুয়েক আগে ইমনের সাথে কথা হলো আমরা চাইমের একটা রিইউনিওন করবো এবং সেটা হয় ঢাকায় নয় নর্থ অ্যামেরিকায় হবে । যতদূর মনে পড়ে তখন খালিদ নিউইয়র্কে চলে গিয়েছে । আমি বললাম খালিদকে ওখান থেকে নিয়ে নিবো আর এদিকে তুমি আমি সামিম বাবুতো আছেই । কিন্তু ভাবনাটা শুধু ভাবনাই থেকে গেল ঐ ব্যাস্ততার কারনে ।
কতবার ভেবেছি এবার নিউইয়র্ক গেলে ওর সাথে আড্ডা মেরে আসবো । যাওয়ার পর মনে হয়েছে “ঠিক আছে এবারতো পারলাম না ব্যস্ততায়, সামনের বার এসে দেখা করে যাবো, ওতো নিউইয়র্কেই আছে, অন্য কোথাও তো আর যাচ্ছে না, আর নিউইয়র্কে যাওয়া তো আমার কাছে কোন ব্যাপার না, গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে ঠিক ৮/৯ ঘন্টাতেই পৌঁছে যাওয়া যায় নিউইয়র্ক” । এই আলস্য ভাবনাটাই সব কিছুকে হারিয়ে ফেলতে সাহায্য করে এবং সারাজীবনের আফসোস হয়ে যায় ।
১৯৮৪ সাল, চাইম ইতিমধ্যে গঠন করে ফেলেছি, চাইমে আমি পড়তাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বিধায় ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামগুলিতে অংশগ্রহনের সুযোগগুলো আমার কাছে আসতো । একবার ব্যাচমেট বন্ধু ফজল বললো ওর টোকাই সমিতির একটা প্রোগ্রামে বাজিয়ে দিতে । রাজী হয়ে গেলাম । অনুষ্ঠানের দিন ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে চাইমের প্রথম কন্সার্ট শুরু হলো । প্রথম থেকেই জমে গেল অনুষ্ঠান । মুহুর্মুহু করতালি আর ওয়ান মোরে ভরে উঠলো সারা হল । অনুষ্ঠান মাঝামাঝি যেতেই দেখলাম ২০/২৫ জনের একটা গ্রুপ মাঝখানের রো ভেদ করে স্টেইজের দিকে আসছে । কাছে আসতেই চিনে ফেললাম গ্রুপের প্রধান ব্যাক্তিকে । ঐ সময় ইউনিভার্সিটি কাঁপত ঐ ভদ্রলোকের নাম শুনলেই । ওনাকে দেখে আমারও কাপাকাপি শুরু হয়ে গেল । উনি স্ট্রেইট স্টেইজে উঠে স্টেইজের পাশের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারায় ডাকলেন । আমি গান বন্ধ করে দিয়ে গিটারটা পাশে রেখে ওনার কাছে যেতে যেতে মনে মনে ভাবলামঃ
ইশ এতো মানুষের সামনে আজ মার খেতে হবে?? আমি কি করেছি?? ও এবার বুঝেঝি, সেদিন ডিপার্ট্মেন্টের সামনে ঐ জুনিওর মেয়েটাকে “তোমার চোখ দুইটা খুব সুন্দর” বলাটা উচিত হয়নি । নিশ্চয়ই ও পাঠিয়েছে ।
কাঁদো কাঁদো হয়ে কাছে গিয়ে বললামঃ
জি ভাই
উনিঃ আমার একটা ছোট ভাই তোমাদের সাথে একটু গাইতে চাচ্ছে, ওকে কি দুইটা গান গাইতে দিবা??
আমিঃ অবশ্যই ভাই, বলেন ওকে আসতে ।
উনি ওনার পাশের ছেলেটাকে দেখিয়ে বললেনঃ
এই ছেলে গাবে ।
আমিঃ চলে আসো স্টেইজের মাঝখানে, কি গাইবা?
ছেলেঃ ফেরদৌস ওয়াহিদের একটা গান ।
আমিঃ আচ্ছা, একটু আমার কানের কাছে গাও ।
ও আমার কানের কাছে এসে ফিশ ফিশ করে গাইলো, আমি স্কেলটা দেখে নিলাম এবং বাকি মিউজিসিয়ানদের বলে দিলাম কি কর্ড হবে। অতঃপর শুরু করে দিলাম বাজানো । মনে মনে ভাবলাম যা গায় গাক, কোন ব্যাপার না, মাইর তো আর খাইতে হবেনা । ইতিমধ্যে ঐ বড়ভাই ওনার ছেলেদের বললেনঃ
এই যা ওদের জন্য বিরিয়ানি, কোক আর সিগারেট নিয়ে আয় ।
প্রিলিউড মিউজিকের পরে ছেলেটা ধরে ফেললো গান । মুহূর্তের মধ্যে ছেলেটার গলার টোন তীরের মতো আমার কানের ভিতরে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করলো, একরকমের খুশীতে মনটা প্রচণ্ড ভাবে নেচে উঠলো, মনে হলো আমি মনে হয় একেই খুঁজছিলাম এতদিন । মানুষের গলা এতো সুন্দর হয়??!! তারমধ্যে এতো হ্যান্ডসাম, এতো সুন্দর ফিগার, এতো গুড লুকিং ছেলের যদি এইরকম মিষ্টি গলা হয়, তাহলেতো ব্যান্ডের খবর হয়ে যাবে । মেয়েদের তো আটকাতে পারবো না, ঝাপায় পড়বে ওর ওপর । মনে মনে ভোকাল কনফার্ম করে ফেললাম । সামিমকে দেখলাম ওর গাওয়া শুনে চমকে গিয়েছে এবং কেমন একটা ভেঙ্গে পড়া চেহারা ও দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে পাশে দাড়িয়ে। সামিমের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগলো এই ভেবে আমিতো আরেকজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছি । মনকে শক্ত করলাম, ভাবলামঃ ব্যান্ড, যুদ্ধ আর প্রেমে কোন কম্প্রোমাইজ করতে হয় না । যুদ্ধে জিততে যেমন ভালো সেনাপতি দরকার, প্রেমে সফল হতেও ভালো প্রেমিক দরকার এবং ব্যান্ডে নাম করতেও ভালো গায়ক দরকার । অবশ্যই সামিম ভালো গায়ক কিন্তু তার কিছুদিন আগে ও দেশের বাইরে চলে যাবে বলে আমাকে জানিয়েছিল বিধায় আমিও নতুন সিংগারের খোঁজে ছিলাম । ব্যাপারটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো হয়ে গেল । যদিও তখন পর্যন্ত জানিনা যে এই ছেলে গাইবে কিনা আমাদের সাথে । ছেলেটা সারা হল কাঁপিয়ে দিলো । ওকে দিয়ে গোটা চারেক গান গাওয়ালাম, অদ্ভুত গাইলো । ওর গাওয়া শেষ হলে আমরা আবার আমাদের বাকি গানগুলি শুরু করলাম । ও দলবলসহ চলে গেল । ভুল করে ওর কোন ফোন নম্বর নেওয়া হলোনা । সেদিনের ঐ ছেলেটার নাম ছিল খালিদ ।
ঐ কনসার্টের কিছুদিন পর খালিদের সাথে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটানার মাধ্যমে কিছুটা হিন্দি সিনেমা “সাত্যিয়া” এর আবহে নতুন করে দেখা হয়ে হলো । একবার এক দুষ্টু ছেলের প্ররোচনায় কোনকিছু না জেনে একদল রংবাজ ছেলেদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে যাই, অর্থাৎ বিষয়টা কি, কে কে জড়িত, কার স্বার্থ এখানে জড়িয়ে আছে, কোন লেভেলের মাস্তানদের সাথে বিরোধ করতে যাচ্ছি কিংবা ওখানে কোন বড় অংকের অর্থ জড়িয়ে আছে কিনা, এসব কোন কিছুই জানা ছিলোনা । বিষয়টাকে আমি এবং আমার আরেক বন্ধু যতটুকু হালকা ভেবে জড়িয়ে পড়েছিলাম ঐ নালায়েক ছেলের প্ররোচনায়, প্রকৃত পক্ষে বিষয়টা অতোটা হালকা ছিলো না বরং বেশ গভীর ছিল । আমরা একটা বিরাট পাওয়ারফুল চক্রের বিরুদ্ধে একটা বাড়ী দখলের ঝামেলায় আটকে গেলাম । এসব ব্যাপারে একবার আটকালে, সহসা মুক্তি পাওয়া যায় না । আমরা যে জড়িয়ে গিয়েছি তা ঠিক ঠাওর করতে পারিনি বিধায় নিঃসংকোচে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । বুঝতে পারিনি যে আমাদের ইতিমধ্যে ঐ চক্র ফলো করছে ।
একদিন সকাল ১১টার দিকে আমি এবং আমার ঐ বন্ধু এসে টিএসসিতে নামলাম । কথা ছিল ইংলিশ ডিপার্ট্মেন্টের বন্ধু খুকুমনির সাথে লাইব্রেরীর সামনে দেখা করবো । ভাবলাম টিএসসির মেসিয়ার সোলেমানের হাতে এক কাপ চা খেয়ে তারপর যাই ওদিকটা । রিক্সা থেকে নামা মাত্র প্রায় ১০/১৫ বাইক এসে আমাদের ঘিরে ফেললো । তাদের মধ্যে একজনকে দেখেই চিনে ফেললাম । ও আমাদের বললোঃ
কই জাস?? বাইকে ওঠ ।
আমরা কোন বাক্যব্যয় না করে ওদের পিছনে বাইকে উঠে পড়লাম কারন ঐ ছেলেটাকে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম । ছেলেটা খুবই নামকরা রংবাজ, নারিন্দায় তার বসবাস হলেও গোপীবাগের ব্রাদার্স ক্লাবে কাটে সময় । খুব প্রভাবশালী । বাড়ী বিষয়ক ঝামেলাটা ওর বিরুদ্ধেই ছিল ।
বন্ধু উঠলো একটায় আর আমি উঠলাম আরেকটায় । ওরা আমাদের নিয়ে জহুরুল হক হলের কমন রুমে নিয়ে গিয়ে দুইটা চেয়ারে বসিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ফেললো এবং চড় থাপ্পড় শুরু হয়ে গেল । বুঝে গেলাম কেচো খুড়তে সাপ উঠিয়ে ফেলেছি । আর ওদিকে যে বাকোয়াজ ছেলেটা আমাদের ফাঁসিয়েছিল, সে তখন কোথায়, আমরা জানিও না । এভাবে যখন মারধর চলছে এবং ধীরে ধীরে স্টেক বাড়ছে, তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো খালিদ এবং সেই বড় গ্রুপটা এসে কমন রুমে ঢুকলো । ওরা দুই গ্রুপই বন্ধু মানুষ, তাই কাকে ধোলাই করা হচ্ছে সেটা দেখতেই এসেছে কমন রুমে, কিছুটা আড্ডা দেওয়ার মুডে । রুমে ঢুকেই সেদিনের সেই মেইন বড়ভাইয়ের চোখ চড়কগাছ, উনি বলে উঠলেনঃ
আররে, কারে নিয়া আসছ তোমরা, এরাতো শিল্পী, এরা কি করসে??
ওরাঃ এই পিচ্চি পোলাপাইন রংবাজ হইয়া গেছে, হালারা আমারে খুঁজতে কাপ্তান বাজারের মোড়ের হোটেলে আইছিল, ঐদিন পাইলে তো পুইতা ফালাইতাম ।আইজকা পাইয়া গেছি টিএসসিতে ।
এর মধ্যেই খালিদ দ্রুত এগিয়ে এলো এবং আমার বাঁধনটা প্রথমেই খুলে দিল এবং তারপর আমার বন্ধুটার । খুলে দিয়ে খুব দ্রুততার সাথে বললোঃ
তোমরা এখনি চলে যাও এখান থেকে ।
ছেলেগুলো বলে উঠলোঃ
এই খালিদ, কি হইলো??!! ছাইড়া দিতেছ কেন?
খালিদঃ আপনি একটা কথাও বলবেন না, ওদের গায়ে একটা টাচও করবেন না । ওরা এখনি চলে যাবে এবং ভবিষ্যতে ওদের যেন কোনধরনের অসুবিধা না হয় ।
খালিদদের ঐ বড়ভাইও বলে উঠলোঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ছোট ভাইরা তোমরা যাওগিয়া, কিছু মনে কইরো না, ওরা বুঝে নাই, ভুল কইরা নিয়ে আসছে তোমাগো ।
রংবাজরা বোকার মতো চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো, খালিদ এবং ঐ বড়ভাইয়ের মুখের ওপর কথা বলার ক্ষমতা ওদের ছিলোনা । আমরা চলে এলাম ।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, একটা সম্পর্কের গোড়াপত্তন কিভাবে হলে সেটা এতো গভীর বা এতো লম্বা হয় । খালিদের সেদিনের রেস্পেক্ট দেখে আমি বিমোহিত হয়েছিলাম । আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে ওর মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল, ও এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারেনি আমাদের ঐরকম অসহায় অবস্থা দেখে । ও রংবাজ ছিল না, ও ছিল একজন শিল্পী এবং সেকারণেই সব রেস্পন্সিবিলিটি নিজের ওপর নিয়ে বিনা শর্তে আমাদের মুক্ত করে দিয়েছিল । হয়তো কোন একটা বিশ্বাস ওকে চালিত করেছে এবং ভাবিয়েছে যে আমাদের কোন দোষ নেই বা আমাদের কোন দোষ থাকতে পারেনা ।
ঠিক মাস খানেক পরের কথা । টিএসসির ক্যাফেটেরিয়াতে শুনতে পেলাম একটা ছেলে টেবিল বাজিয়ে গান গাচ্ছে । চারিদিকে ভিড় হয়ে গিয়েছে । আমি এগিয়ে গেলাম, গিয়ে দেখি খালিদ গাচ্ছে আর ওদের ঐ বড় গ্রুপটা বসে ওর গান শুনছে । আমাকে দেখেই সেই বড়ভাই ডাকলেনঃ
আসো আসো ছোটভাই, এখানে বসো ।
আমি বসলাম । ওর গান শেষ হলে আর দেরী করলাম না, সোজা অফার করলামঃ
আমাদের ব্যান্ডে গাইবা?
খালিদের চোখ চক চক করে উঠলো, অ বললোঃ হ্যাঁ
ঐ বড়ভাইঃ আরে কি কও, গাবে না মানে, অবশ্যই গাবে । ঐ সোলেমান ওরে চা আর শিঙ্গাড়া দে ।
আমি ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড খুশী হয়ে গেলাম । আমরা তখন প্র্যাক্টিস করতাম বন্ধু টমের বাসায় । খালিদকে পরদিন ওখানে চলে আসতে বললাম । সামিমের জন্য খারাপ লাগলো কিন্তু শামিম নিজেও তো বিদেশ চলে যাওয়ার ব্যাবস্থা আগেই করে রেখেছে তাই খালিদ ছিল সাপে বর । আর পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে । ব্যান্ডরা কত খোঁজাখুঁজির পর একটা ভালো ভোকালিস্ট পায় কপাল ভালো থাকলে । অনেক ব্যান্ডতো সারা জীবন শুধু খুজেই যায় একজন ভালো ভোকালিস্ট । অথচ আমার কপাল কি ভালো যে একেবারে বেস্ট গায়ককেই আমি পেয়ে গেলাম কি এক ঘটনার মাধমে ।
এই মেইন ভোকালিস্টরা কিছু প্রেমিকাসুলভ ব্যাবহার করে অর্থাৎ বাকি সব মেম্বারের একমাত্র প্রেমিকা হয় এই মেইন ভোকালিস্ট। এঁরা খুব আল্লাদি হয়ে থাকে, মাঝে মধ্যেই পোলাপানের মতো আল্লাদ করে এবং এমন কিছু আবদার করে যা অন্য কোন মেম্বার করলে কানসাতে ঠাসাইয়া চটকনা খাইতো । বেশীর ভাগ মেইন ভোকালিস্ট সব সময় দেরী করে আসবে প্র্যাক্টিস কিংবা প্রোগ্রামে । খালিদও ঠিক সেরকম আল্লাদি ছিল । ওকে আমি কিছু করতে দিতাম না, ইন্সট্রুমেন্ট টানাটানি থেকে শুরু করে যত রকম ব্যান্ড ম্যানেজমেন্টের কাজ নিজে করতাম এবং ব্যান্ডের অন্য মেম্বারদের দিতাম এবং ওকে খুব এক্সক্লুসিভ ভাবে রাখতাম । কোথাও প্রোগ্রামে গেলে ওর জন্য ভালো রুমটা দিতাম, ও কি খাবে সেটা খেয়াল রাখতাম, ওর যাতে কোন অসুবিধা না হয়য় সবার অলকে সেটাও আমার খেয়ালে থাকতো । কাউকে বুঝতে দিতাম না যে ওর প্রতি আমাত অ্যাটেনশনটা কোন পর্যায়ের কারন সেটা বুঝলে তো ব্যান্ডে গ্যাঞ্জাম লেগে যাবে । কেন যেন মনের অজান্তে ওকে খুব আদর করতাম । ও আমার মাত্র এক ব্যাচ জুনিওর ছিল কিন্তু আমাকে ও মানত বড়ভাই হিসাবে । আমি ওকে তুই বলতাম আর ও আমাকে তুমি বলতো । আমি যা বলতাম, ও তাই শুনত , একবারের জন্য প্রশ্ন করতো না “কেন করবো এটা”। এই আল্লাদে আল্লাদে অলস হয়ে গিয়েছিলো ও । কোন কন্সার্টে গিয়ে স্টেইজে একটা ইন্সট্রুমেন্ট টানাটানিতে হাত দিতনা, নায়কের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো । অন্য মেম্বাররা মাঝে মাঝে বলে উঠতোঃ
কিবে শ্বশুর বাড়ী আইসোস নাকি? হাত লাগা শালার পো ।
ওর কিছু ড্রেসের স্টাইল ব্যান্ডের ছেলেদের পছন্দ ছিলনা । একটু নায়ক নায়ক ব্যাপার ছিল ওর মধ্যে । আমি বিষয়টা নিয়ে কোনদিনও কিছু বলিনি কিন্তু পাবলিকের মুখ তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না অর্থাৎ ব্যান্ডের অন্য মেম্বারদের তো আর কন্ট্রোল করা যায় না । ওরা মাঝে মধ্যে বলে উঠতোঃ দেখসোস হালায় কি পইরা আসছে, পুরা ইলিয়াস কাঞ্চন হাহাহাহাহাহা । বিষয়টা ও জানতো জে ওকে আমরা মাঝে মধ্যে ইলিয়াস ডাকতাম । ও এসব কানেই নিতনা । তবে ও চাইলে নায়ক হওয়াও ওর জন্য কঠিন কোন ব্যাপার ছিলনা ।
ওর প্রিয় একটা বিষয় ছিল বাবু সেজে বাইক চালানো । একদিন দেখি বাইক নিয়ে টিএসসির ভিতরে চলে এসেছে । আমি বললামঃ
হ খুব ভালো হইসে, এইবার গিয়া টিএসসির ছাদে ওঠ । তুই এতো মাজুল কেন?? আর কাম পাস না?
ওর এভাবে টিএসসির ভিতরে বাইক নিয়ে আসার জন্য বন্ধু অভি আমাকে ডেকে বললোঃ
ও বাইক নিয়া ভিতরে ঢুকসে কেন? ওরে বারন কইরা দিস, টিএসসি বাইক চালানোর জায়গা না ।
আমি ব্যাপারটাকে হালকা করার ব্যাবস্থা করলাম । আমার হয়েছিল বিপদ, কারন খালিদরা করতো আওয়ামীলীগ আর অভিরা করতো বিএনপি । ওদিকে দুই দলেই আমার বন্ধুরা ছিল বিধায় স্যাম রাখি না কুল রাখি, এই নিয়ে বিপদে পড়ে যেতাম ।
মূল গল্পে ফিরে আসি । পরেরদিন খালিদ প্র্যাক্টিসে আসলো । ওর আসা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম । ১০/১৫টা মটর সাইকেল, ২০/২৫ ছেলেপেলে, সাথে ঐ বড়ভাই । টমের পাড়ার ছেলেরা চলে এলো জিজ্ঞাসা করতে কিছু হয়েছে কিনা । আমরা বললামঃ না দোস্ত, আমাগো ব্যান্ডে নতুন সিংগার খালিদ আইছে আর ওনারা ওর বন্ধু বান্ধব ।
এরপর ঐ বড় ভাই সবার জন্য স্টার থেকে বিরিয়ানি, চা, ৪ প্যাকেট বেনসন সিগারেট আনালেন । আমরা প্র্যাক্টিস করবো নাকি খাবো, বুঝতে পারছিলাম না ।
এরপর থেকে প্রতি প্র্যাক্টিসে মিনিমাম ১০টা মটরসাইকেল এবং তাবৎ খাওয়া দাওয়া আসতে থাকলো । বিনা পয়সায় এই পরিমান খাওয়া দাওয়ার আতিশয্যে আমরা পাগল হয়ে গেলাম । এক পর্যায়ে খালিদকে বললামঃ আচ্ছা প্র্যাকটিসে কি এভাবেই তোমরা আসতে থাকবা? এতো লোক আসলে কি প্র্যাকটিস হয়?
ও আমাকে আশ্বস্ত করলো আর আসবেনা কেউ এই বলে । যাইহোক ওনারা আসা কমালেন আর আমাদেওর প্র্যাক্টিস বেড়ে গেল ।
খালিদের বাড়ী গোপালগঞ্জ । সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেও। খালিদের মেঝো ভাই অর্থাৎ ফারুক ভাই যে সময়টায় রিভার ল’এর ওপর পিএইচডি করেছিলেন, তখন সম্ভবত বাংলাদেশে হাতে গোনা দুয়েকজন করেছিল ঐ সাবজেক্টে পিএইচডি । ওর প্রতিটা ভাই বোন উচ্চশিক্ষিত এবং মার্জিত । বিশাল ঘরের ছেলে এই খালিদ । কি পরিমান পাওয়ারফুল ছিল ও, তা কেউ কোনদিনও জানতে পারেনি একমাত্র আমি ছাড়া । অথচ এতো সাধারণ একটা জীবন নিয়ে চলাফেরা করতো, দেখে মনে হতো ওর বোধহয় কেউ নাই । আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম ওর চলাফেরা দেখে । বুঝতাম যে ও একেবারে শিল্পী, যার কারনে ও মোটেই বস্তুবাদী ছিলোনা । ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিলসফিতে অনার্স মাস্টার্স করা ছেলে জীবনে কোনদিনও একটা চাকরীর জন্য আবেদন করেনি শুধুমাত্র দুলাইন গান শোনাবে বলে । ও ভালো ছাত্র ছিল অথচ সেই গর্বে কোনদিনও গর্বিত না হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো একটু গান গাওয়ার জন্য । নিয়তির কি পরিহাস যে ওর এই সাধাসিদা জীবন যাপনের জন্য, অর্থাৎ কোন হাকডাকবিহীন ডাউন টুওয়ার্ডস আর্থ টাইপ চালচলনের কারনে ওর হয়ে কেউ বলার নাই “খালিদ কোনদিনও কারও কাছে ফেভার চায়নি, কোন পুরস্কারে জন্য কারও কাছে যায়নি, কোন সাংবাদিকের পেছনে ঘোরেনি প্রচারের জন্য কিংবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কারও কাছে ধর্না দেয়নি” ।
কেন যেন আমি ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট কিংবা ভোকালিস্ট খুব ভালো ভাবে চিনতে পারি এবং আমার ভাগ্যে বার বার বাংলাদেশের টপ ভোকালিস্টরা এসে পড়ে, যেমন খালিদ কিংবা হাসান । আপনারা হয়তবা অনেক রঙ, অনেক সাজ কিংবা অনেক আড়ম্বরের মাঝে এঁদের ঠিকমতো চিনতে পারেন না কিংবা বুঝতে পারেন না যে এরা একেকজন হীরার খনি । এদের যত ধার দিবেন, তত চকচক করবে এবং কেটে ফেলবে সব চাইতে কঠিন কাঁচকে । এঁরা একেকটা শতাব্দী সৃষ্টি করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল । আজ এরা ঠিক পাশের দেশে থাকেলেই কোটি টাকা দিয়ে দেশে এনে এঁদের গান শুনতেন । হাতের কাছে পেয়েও হাজার তারার ভিড়ে শুকতারাকে চিনতে পারলেন না । এদের মতো এতো সুরে গাওয়া শিল্পী জন্মে কম। এরা হলো জাত শিল্পী যাদের কোন অটোটিউন লাগেনা সুরে গাইতে । এরা ঐ সময় গান এক টেকে ওকে করা গায়ক।
তবে আমার দুঃখ লাগে একটা বিষয় ভেবে যে খালিদের শিল্পী স্বত্বাটা এতই প্রকট ছিল যে ও নিজেকেই চিনলোনা, নিজেকে রেপ্রেজেন্টেশনও করতে পারলোনা, নিজের ভ্যালু নিজে বাড়াতে জানেলোনা, নিজের যত্নটা সঠিক ভাবে নিতে পারলোনা এবং একবারের জন্য অনুধাবন করলোনা যে কোন পর্যায়ের গায়ক ও নিজেই । এই ধরনের বোহেমিয়ান প্রকৃতির শিল্পীরা এক প্লেট খাওয়া পেলেই এদের পেট ভরে যায়, চিন্তা করেনা কাল কি খাবো কিংবা রিটায়ারমেন্টে কি খেয়ে বাঁচবো । এঁরা কেউ চালাক না, মানুষ এদের ঘাড়ে কাঠাল ভেঙ্গে খেলেও এরা বুঝতে পারেনা যে ওদের ইউজ করা হচ্ছে ।
খালিদের কথা বলতে গিয়ে চাইমের প্রথম রেকর্ডিংয়ের কথা মনে পড়ে গেল । রেকর্ডিং করেছিলাম ঝংকার স্টুডিওতে । ওটা ছিল তেজগাঁয়ে । ঝংকারের মালিক ছিল খোশনুর । ভালো ছেলে ছিল তবে খুব চঞ্চল ছিল । একদিন একটা গানের ভোকাল দেওয়ার জন্য রাত ১০টার দিকে শিফট পেলাম । প্রথম প্রথম ব্যান্ডের রেকর্ডিং করলে কিছুটা উৎসবের মতো মনে হয়, আমাদের তাই হলো । আমাদের সাথে বন্ধু বান্ধবসহ এমন ছেলেও আসতো যাদের চিনতাম না । বাসা থেকে আম্মা বিরাট ডেকচিতে বিরিয়ানি রান্না করে পাঠায় দিচ্ছেন, দোকান থেকে চা বিস্কুট আসছে, সিগারেটের কোন হিসাব নাই, রীতিমতো হই হই রই রই কান্ড । যাইহোক খেয়েদেয়ে একটা গানের (গানটা সম্ভবত “আমার জন্য লেখো শুধু একটা গান”) ভোকাল নেওয়ার জন্য খালিদ ও শামিমকে ভোকাল রুমে পাঠালাম । ওরা ভোকাল দেওয়া শুরু করলো । দিচ্ছে দিচ্ছে দিচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে বার বার কিন্তু আমার কাছে পারফেক্ট লাগছে না বিধায় কন্টিনিওয়াস টেক নিচ্ছি । টেক নিতে নিতে রাত বারটা, একটা এবং দুইটা বেজে গেল কিন্তু পারফেক্ট টেকটা পেলাম না । সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম, আমরা মেইন প্যানেলে বসে ছিলাম যেখানে এসি ছিল । কিন্তু ভোকাল রুমে কোন এসি ছিলনা । এমনি হিউজ ইন্সুলেটেড রুম, তারপর আবার গরম । ইন্সুলেটেড এবং অ্যাকস্টিক্যালি ট্রিটেড রুম গুলি কিছুটা দম বন্ধ টাইপের হয়ে থাকে যদি প্রপার এয়ার সার্কুলেশন না থাকে, আর যদি এসি না থাকে, তাহলে তো রীতিমত দোজোখ । ওদের ঐ ভোকাল রুমটায় কোন এসি না থাকায় গরম চুল্লির মতো অবস্থা হয়ে ছিল এবং ওখানে দাড়িয়েই ওরা ভোকাল দিচ্ছিল । অ্যাবনরমাল গরমের মধ্যে ওরা অবশেষে রাত্রি সাড়ে তিনটার দিকে ভোকাল দেওয়া শেষ করলো । গাওয়া শেষ করে ওরা প্যানেলে দৌড়ে এলো কেমন গাইলো শোনার জন্য । ওদের দেখে ব্যান্ডের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো কারন দুজনের গায়ে কোন কাপড় চোপড় নাই, না সার্ট না প্যান্ট । শুধু একটা জাঙ্গিয়া পরে আছে । সারা গাঁ বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে । কারন ঐ রুমের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ওরা কাপড় চোপড় সব খুলে ভোকাল দিয়েছে । ভাগ্য ভালো যে সাড়ে তিন্টার মধ্যে টেক ওকে হয়ে গিয়াছিলো । ভোর হয়ে গেলে হয়তো ওদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখতে হতো ।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল । ব্যান্ড নিয়ে একবার গেলাম সিলেট টি গার্ডেনে থার্টি ফার্স্ট পার্টীতে পারফর্ম করতে । থার্টি ফার্স্ট পার্টীতে সাধারণত ইংরেজি গানই গাওয়া হতো । কিন্তু আমাদের স্টকে মাত্র গোটা দশেক গান ছিল । প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পরেই ১০ গানের স্টক শেষ হয়ে গেল । ভাগ্য ভালো যে টি গার্ডেনের কর্মকর্তাদের একজনের বউয়ের সাথে আরেকজনের নাচাকে কেন্দ্র করে মারামারি লেগে গেল । আমাদের গান থেমে গেল । আরও কিছু লোকজন এসে মারামারি কন্ট্রোল করে ফেললো । সবাই ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসলো । আমাদের আর ইংরেজি গান স্টকে ছিলোনা বিধায় খালেদ ধরে ফেললো “এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে” । ড্যান্স পার্টিতে আসা লোকজন আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল আমাদের দিকে । কোথায় গাওয়ার কথা ইংরেজি, আমরা শুরু করে দিয়েছি “এই কি গো শেষ দান”। এরপর খালিদ পর পর কয়েকটা অনুপ ঘোষাল ঝেড়ে দিলো । পার্টির বারটা মারপিট দিয়ে বেজেছিলো, আমরা অনুপ ঘোষাল ঝেড়ে তেরোটা বাজিয়ে দিলাম । এর পরে ওরা আর কোনদিন আমাদের ডাকেনি অনুপ ঘোষালের ভয়ে ।
তবে খালিদ ছিল ঐ লেভেলের গায়ক যে হারমোনিয়াম ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন ধরনের গান শুনিয়ে যেতে পারতো । যে যা গাইতে বলতো, তাই গেয়ে শুনিয়ে দিতো । একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল । একবার খালিদকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম । বললামঃ
তুই রাবীন্দ্র জায়েনের “তুমি ভুল আমার দিয়েছ ভেঙ্গে বন্ধু করেছ ভালো” গানটা যদি ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিটা নোট পারফেক্টলি তুলে এনে শোনাতে পারিস তাহলে বুঝুম গান গাইতে পারোস।
শালা ঠিক তিনদিন পরে এসে ডিটো শুনিয়ে দিল গানটা। আমি মনে মনে ভাবলাম “তুই আসলেই শিল্পী”।
গান পারফেক্টলি তোলা নিয়ে ওর সাথে আমার মাঝে মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো । যে কোন কঠিন গান পেলেই বসে যেতাম আর বলতামঃ দেখি দেখা তোর কেরদানি ।
ও ঠিকই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতো এবং এক সময় ঠিকই তুলে দেখিয়ে দিতো । একজন অত্যন্ত ভালো গায়ক বা গায়িকার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা গুন হচ্ছে সে কত পারফেক্টলি অনুকরন করতে পারে, তা সে গান হোক কিংবা কারো কথার ধরন হোক, কিংবা কোন টোন হোক, কিংবা গানের কাজ হোক কিংবা গানের নোট হোক । যারা প্রতিষ্ঠিত গায়ক গায়িকা, তাদের মধ্যে ৯০ পারসেন্ট অসম্ভব রকম অনুকরন করতে পারে খুব সাবলিল ভাবে এবং সেটাই তাকে সাহায্য করে যখন মিউজিক ডিরেক্টর কোন গান তুলে দেয় । সে নিমিষেই তুলে ফেলে যে কোন কঠিন গান।
খালিদকে নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে, একটা সময় চলে আসে, একটা ইতিহাসের টুকরো চলে আসে । একসাথে কাটানো কত মুহূর্ত, কত সময়, কত ঘটনা, সবকিছুই চোখের সামনে এসে ভিড় করে । খুব আশ্চর্য লাগে এই ভেবেঃ কিছু মানুষ আমাদের সাথেই এসেছিলো, আমাদের সাথেই কাটিয়েছিল সময়, আমাদের সাথেই গেয়েছিল গান, তারপর একটা সময় আমাদের ফেলে রেখে একাই চলে গিয়েছিল । যেমন খালিদ কিংবা নীলয় কিংবা বাচ্চু কিংবা ইশতিয়াক, আরও কত কত নাম । এঁরা আর কোনদিনও ফিরে আসবে না, যেমন আসবে না ফিরে খালিদ ।
লেখক: চাইম এবং আর্ক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা