গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান স্মরণে

:: ফিরোজ আহমেদ ::

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান আমার একজন ব্যক্তিগত নায়ক ছিলেন। তেমন কিছু না, ১৯৯১ সালে শাহীন কলেজে থাকতে একবার আন্তকলেজ দাবা প্রতিযোগিতায় আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম (অনুষ্ঠিত হয়েছিলো নটরডেম কলেজে) তখনকার আলোচিত দাবাড়ুদের কয়েকজনের সাথে। জিয়া, রিফাত এরা সেই সতেরো আঠারো বছর বয়েসেই আমাদের তারকা। আমাদের কলেজের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু যিনি ছিলেন, তার সাথেই আমার ছিলো যোজন যোজন দূরত্ব। কিন্তু সেই ছেলেটাও বেশ দ্রুত সময়েই মাত্ রিফাতের কাছে। আমরা তিন বোর্ডেই হেরেছি তিনটা কলেজের কাছে, অবিশ্বাস্য লাগলেও এদের মাঝে একটা ছিলো নারায়নগঞ্জের তোলারাম কলেজ। এর বাইরে বাকি কলেজগুলোর সাথে কয়েকটা বোর্ডে জিতলেও তখন যারা ভালো দাবা খেলতেন, তারা আসলেই প্রশিক্ষণ আর নিজস্ব প্রতিভার গুনে অপ্রশিক্ষিত আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।

প্রশিক্ষণ বিষয়টা নিয়েই খানিকটা বলি। আমাদের তিন জনের মাঝে তৃতীয় জন ছিলেন চলনসই। আর নিজের খেলা নিয়ে তখনই জানতাম, দাবা নিয়ে প্রাণান্ত পরিশ্রম করলেও বড়জোর ফিদে মাস্টার হতে পারবো, নাও পারতে পারি। কিন্তু আমাদের মাঝে যে প্রথম ছিলো, তার খেলাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম আমি। জিয়া আর রিফাতের চাইতে তিনি সম্ভবত পিছিয়ে ছিলেন ওদের দুইজনের অল্প বয়েসেই পাওয়া প্রশিক্ষণের সাপেক্ষে। দুর্দান্ত প্রতিভা আর সৃজনশীলতার সত্ত্বেও, এবং একইসাথে বিপুল পরিশ্রমের পরও, আমার সেই সহপাঠী তাই ফিডে মাস্টারের চাইতে বেশিদূর আগাতে পারেননি। দৈনিকে নিয়মিতই জাতীয় দাবার খবর পড়তাম, কারণ জানতাম সহপাঠীর নাম দেখতে পাবো। জাতীয় স্তরে ভালোই করেছে সে।

জিয়ার গ্রান্ড মাস্টার হবার নর্ম অর্জনের চূড়ান্ত খেলাটা নানান উত্তেজনার কারণে দাবা ফেডারেশনে আলোচিত হয়েছিলো। সম্ভবত কোন পত্রিকায় তখন সেই ঘটনা না আসলেও বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিলাম কিভাবে সেই স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধে, প্রায় ব্যক্তিগত যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যাওয়া টুর্নামেন্টের সেই শেষ খেলায় জিয়া বিজয়ী হিসেবে বেড়িয়ে এসেছিলো। কেন এই গল্পগুলো গণমাধ্যমে আলোচিত হয় না? কারণ “চালু” বিষয় নিয়ে আলাপে “চাল্লু” আমাদের ক্রীড়া বুদ্ধিজীবীরা রোমাঞ্চ অন্যত্র খোঁজে? এটা কারণের অর্ধেক আসলে। কুইনস গ্যামবিটের চাইতে কম মুগ্ধ হবার মত নয় আমাদের দাবার ইতিহাস। দাবাড়ুদের অজস্র হাসিকান্নার, ব্যক্তিগত ত্যাগের ঘটনা বড় বিষয় হয় না, কারণ আসলে দাবা ৮০ এবং ৯০ দশকে যেটুকু এগিয়েছিলো, তারপর মাফিয়া খপপড়ে বন্দি হয়ে গেলো একসময়ে। তারপর দাবা একদম নিস্তেজ। বুদ্ধিজীবীরা কেন সেটা নিয়ে আলাপ করবেন, যেটা বড়সড় পাঠকের আগ্রহের বিষয় না? তাই নিয়াজ মোর্শেদ জিয়া রিফাতের মত অর্জনের নাম নতুন সময়ের পাঠকরা প্রায় জানেন না।

কিন্তু আমাদের প্রজন্মের দুই অবিশ্বাস্য ঘটনা জিয়া আর রিফাত। আমাদের চাইতে কিছু পরের রাকিব। কলেজে ভর্তি হবার আগেই জিয়া আর রিফাত দুই জনেরই নাম শুনেছি, তাদের কীর্তি জানি। সম্ভবত প্রথম ওদের দেখেছি নিয়াজ মোর্শেদের নামে হওয়া একটা আন্তবিদ্যালয় দাবা প্রতিযোগিতায়। ওটা হয়েছিলো সেন্ট জোসেফ কলেজে। মনে হয় তখন আমরা সপ্তম শ্রেণি। সেখানে অংশ নিয়েছিলাম, কয়েকটা হার জিতের পর দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া হয়নি। কিন্তু প্রতিযোগিতাটি দাবা নিয়ে যে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিলো ঢাকা জুড়ে, সেই স্মৃতি আজও টাটকা।

এই প্রতিযোগিতাটি আমার জীবনের অন্যতম মধুর স্মৃতি। এখনও মনে করতে পারি, কলেজটিতে ঢুকে বিস্মিত হয়েছিলাম, এত সুপরিসর এক একটা ভবন, এত দারুণ বসবার ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য, এত অমায়িক শিক্ষকরা! খুব নরম করে একজন শিক্ষক আমাদের বোর্ডটা ঠিক করে দিলেন, উত্তেজনায় খেয়াল করা হয়নি বোর্ডে সর্বডানের ঘরটা কালো সাজিয়েছি! কিন্তু যারা আমাদের চাইতে বেশি দড় ছিলো, তারা আগেই জানতো জিয়া আর রিফাতকে, তাদের নামে ফিসফাস শুনতাম। এই দুই নাম খুব কম বয়েস থেকে একত্রে উচ্চারিত হতো। আর সবার আগে সঙ্গতকারণেই আসতো নিয়াজ মোর্শেদের নাম।

জিয়ার গ্রান্ড মাস্টার হবার নর্ম অর্জনের চূড়ান্ত খেলাটা নানান উত্তেজনার কারণে দাবা ফেডারেশনে আলোচিত হয়েছিলো। সম্ভবত কোন পত্রিকায় তখন সেই ঘটনা না আসলেও বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিলাম কিভাবে সেই স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধে, প্রায় ব্যক্তিগত যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যাওয়া টুর্নামেন্টের সেই শেষ খেলায় জিয়া বিজয়ী হিসেবে বেড়িয়ে এসেছিলো। কেন এই গল্পগুলো গণমাধ্যমে আলোচিত হয় না? কারণ “চালু” বিষয় নিয়ে আলাপে “চাল্লু” আমাদের ক্রীড়া বুদ্ধিজীবীরা রোমাঞ্চ অন্যত্র খোঁজে? এটা কারণের অর্ধেক আসলে। কুইনস গ্যামবিটের চাইতে কম মুগ্ধ হবার মত নয় আমাদের দাবার ইতিহাস। দাবাড়ুদের অজস্র হাসিকান্নার, ব্যক্তিগত ত্যাগের ঘটনা বড় বিষয় হয় না, কারণ আসলে দাবা ৮০ এবং ৯০ দশকে যেটুকু এগিয়েছিলো, তারপর মাফিয়া খপপড়ে বন্দি হয়ে গেলো একসময়ে। তারপর দাবা একদম নিস্তেজ। বুদ্ধিজীবীরা কেন সেটা নিয়ে আলাপ করবেন, যেটা বড়সড় পাঠকের আগ্রহের বিষয় না? তাই নিয়াজ মোর্শেদ জিয়া রিফাতের মত অর্জনের নাম নতুন সময়ের পাঠকরা প্রায় জানেন না।

আমলা এবং বড় ব্যবসায়ীরা যে দেশের প্রধান কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সেই দেশের সামনে অনেক বড় বিপদ থাকে। জিয়া আর রিফাতের দিকে তাকালে, সংবাদ পত্রিকার পাতায় তারা ক্রমাগত কম থেকে কমতর জায়গা পেতে থাকলে প্রতিবছর এই কথাগুলো আমার মনে হতো। এইখানে তুমি পাতলা পাতলা অনেক কাজ করে পৃষ্ঠপোষকতা পাবে, কিন্তু অনেক ভালো কাজ হয়তো পাত্তাও পাবে না। দৃষ্টি আকর্ষণ হলো বড় কথা।

জিয়া রিফতারা যথেষ্ট পরিমানে বিদেশে খেলতেই যেতে পারতো না পৃষ্ঠপোষকের অভাবে। আমি শুনেছি খাবার কষ্ট, থাকবার জায়গার কষ্টের কথাও। ব্যাঙ্ক আর নানান প্রতিষ্ঠান, এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাপা হওয়া হাজার গ্রাম অফসেটে ফালতু আধাখেচড়া এক একটা চাররঙা মোসাহেবী বই দেখলে আমার সব সময় প্রথম মনে হতো জিয়া আর রিফাতের মত প্রতিভাদের চাকরি না করতে হলে তারা হয়তো দ্বিগ্বিজয় করতে পারতো। সবার আগে তাদের দুই জনের কথাই মনে হতো, এইটা সৃষ্টিকর্তার কসম করে বলতে পারি। কারণ, এই অভাবের কথাটা প্রায় নিয়মিত তখনকার গণমাধ্যমে আসতো। তারপর একসময় গণমাধ্যমও তাদের প্রায় ভুলে গেছে, আমাদেরও দুঃখ কমেছে, “নক্ষত্রেরও তো একদিন মরে যেতে হয়”।

দাবা নিয়ে আমার সেই ভাবাবেগ এখনো আছে। যে কোন শিশুর সাথে দিন কয়েকের পরিচয় হলে জানতে চাই দাবা পারে কি না। অবাক কাণ্ড, আমার দুই প্রিয় বন্ধুর শিশুপুত্র অসম্ভব ভালো দাবা খেলে। একজনের দিকে তাকালে তো মনে হয় মোহমুগ্ধের মত দাবার দিকে ধ্যান করে থাকে। তাকে কয়েকটা জটিল সমস্যা সমাধান করতে দিয়েছিলাম। দশ না পেরুনো সেই শিশুটি প্রাপ্তবয়স্কদের উপযুক্ত ধাঁধাগুলো সমাধান করেছিলো, দেখে মুদ্ধ হই। জানা গেলো, চট্টগ্রাম শহরের কিছু পাগলপ্রায় সাবেক দাবাড়ু অনেকটা নিজেদের উদ্যোগে এই কাজটা করছেন, শিশুদের মাঝে প্রতিভা খুঁজে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার। এরা যদি পৃষ্ঠপোষক পেতেন!

এই দুই শিশুর জন্য আমি দাবার বই খুঁজেছি ঢাকার বাজারে। কোন দোকানে দাবার বই নাই! অথচ আমার শাহীন কলেজের সহপাঠীর কাছ থেকে নাম নিয়ে নিউ মার্কেট থেকে কিনেছিলাম “চেস মাস্টার ভার্সেস চেস অ্যামেচার” নামের একটা বই। আমার মত খুবই মাঝারি দাবাড়ুরও জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলো এই বইটা। কোনা দোকানে এখন আর তেমন বই মিললো না।

দাবা নিয়ে সর্বশেষ স্মৃতিটা কী বলবো? বলা উচিত।

দেশের প্রথম তিন গ্রান্ড মাস্টারের একজনকে আমি নাম্বার যোগাড় করে ফোন দিয়েছিলাম, যদি এই নতুন যুগের শিশুদের জন্য একটা দাবার ভালো বাংলা বই তৈরি করা যায়! তিনি প্রথমে দাবা নিয়ে হতাশা জানালেন। তারপর অনেকক্ষণ ধরে তাকে আমার শৈশবের মুগ্ধতার কথা জানালাম, বললাম অদাবাড়ু আমার মতই হাজার হাজার ভক্ত আছে তার। গণমাধ্যম নাই বা জায়গা দিলো। একটু ভরসা পেলেন। তারপর দিন আবারও হতাশা। এবং তারপর আর ফোন ধরেননি আমার। আমার শাহীন কলেজের সহপাঠীকেও ফোন করেছিলাম এমন একটা বই করা যায় কি না, সেটা বিবেচনা করতে। মফস্বলী শৈশব জীবনের প্রশিক্ষণহীনতার কারণে শুরুতে পিছিয়ে থাকলেও দাবা বিষয়ে পরবর্তীতে সে এত গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলো, সেটা একটা বই না লিখলে অপচয় হবে। কিন্তু সে বড় ব্যস্ত। এইরকম প্রত্যাখ্যানের পরও কতটা আবেগ থাকলে বাকি দুই জন গ্রান্ড মাস্টারকেও ফোন করার, যে কোন দিন সেটা করে ফেলার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি, সেটা বোঝাই যায়।

দাবা নিয়ে বিপুল ভালোবাসা সত্ত্বেও এদের হতাশার কারণও বিপুল। ফেডারেশন এর ভয়াবহ দুর্নীতির প্রতিবাদে এরা বিকল্প কমিটিও গঠন করে চালাবার চেষ্টা করেছেন। র‍্যাবের ডিজি বেনজির সাহেব একবার বিপুল দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে আরো “উচ্চতর” তদন্তের কমিটি বানিয়েছিলেন। এইসব যা হয় আর কি। বিশ্বমানের প্রতিভাবান এই দাবাড়ুরা তারপর বুঝে গেছেন, দাবার বাইরে আর্থিক নিরাপত্তার জগত খুঁজতে হবে। সেখানেই উন্নতিতে মন দিতে হবে। নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা নিয়েই তারা সরে গেছেন। এখন একটা বই এর প্রকাশ তাদের কি বা স্বপ্ন দেখাবে!

নিয়াজ মোর্শেদ, জিয়া আর রিফাতের সাথে জাতি যা করেছে, তা অন্যায়। তাদের শুধু আরও পৃষ্ঠপোষকতা নয়, আরও বহুগুন বেশি মর্যাদা পাবার কথা ছিলো।

কিন্তু এসব কথা থাক। জিয়া বিদায় নিলো, সমবয়সী নায়ক, বহুদূরের তারকা। তাকে বিদায় জানাই। আশা করতে ভয় লাগে, নতুন দাবাড়ুরা হয়তো তাদের শূন্যতা কিছুটা ভরাট করবেন।

ভালোবাসা জেনো, গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান।

লেখক: গণসংহতি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *