আমাদের মোশাররফ রুবেল স্মরণে

:: দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ::

২০০৮ সালে মোহাম্মদ রফিক অবসরে গেলেন। আমরা রফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পর দেশের সেরা স্পিনার হবে কে? রফিক ভাই রাজ্জাক, সাকিবের নাম করতে পারতেন। এমনকি ইলিয়াস সানির কথা বললেও অবাক হতাম না। কিন্তু এসব ছেড়ে রফিক ভাই বললেন- মোশাররফ রুবেল।

হ্যা, আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু মোশাররফ রুবেল। অকালে এই দুনিয়াটা ছেড়ে যাওয়া রুবেল।

রফিক ভাইয়ের অবসরের পরই, ওই বছরই দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হয়ে যায় তার। তেমন কোনো পারফরম্যান্স ছিলো না; কিন্তু সম্ভাবনা ছিলো। সেই সম্ভাবনাকে দৃশ্যত শেষ করে দিয়েছিলো আইসিএল। এক ঝাক মেধাবি ক্রিকেটারের সাথে রুবেলও পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে।

আইসিএল নিষেধাজ্ঞার পর অনেকেই আবার জাতীয় দলের স্রোতে ফিরে এসেছিলেন। রুবেলকে সে জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো। তবে হাল ছাড়েননি।

২০১৩ সাল থেকে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দারুন পারফরমার ছিলেন। সে বছর বিপিএলের ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ফাইনালে। এরপর থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন দারুণ লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। ২০১৬ সালে পুরষ্কার পেয়েছিলেন। আট বছর বিরতি দিয়ে আবার জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। ফিরে ক্যারিয়ার সেরা বোলিংও করেছিলেন।

এরপরও হয়তো রুবেল স্বপ্ন দেখতেন। ‘হয়তো’ বলি কেন? রুবেলের বুক ভরা স্বপ্নই ছিলো। সবসময় চাইতেন পারফরম করতে, আবার জাতীয় দলে ফিরতেন। ২০১৯ সালে প্রথম যখন ব্রেন টিউমার ধরা পড়লো, তার পরেও মাঠে ফেরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সময় তার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সব কেড়ে নিয়েছে।

সুন্দর গোছানো সংসার ছিল; একটা মাথা গোজার ঠাই ছিলো। এই মারণব্যধির সাথে লড়তে গিয়ে সবই গেছে। এই সময়ে তার স্ত্রী ফারহানা রুপা চৈতী নিজেকে মহীয়সী এক নারী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। দৃঢ়তার সাথে সামলেছেন সব, রোমান্টিকতার সাথে রুবেলের শেষ সময়টা সুন্দর করে রেখেছেন।

শুধু চৈতীর লড়াই আর শেষ লহমা অবধি রুবেলকে প্রেমের আদরে রাখার যে চেষ্টা, তা নিয়ে উপন্যাস হতে পারে। এই মেয়েটির সাথে আমার শতবার ফোনে কথা হয়েছে রুবেলের অসুস্থতার সময়। একটা পলের জন্যও সে রুবেলের এই স্মৃতিভ্রষ্টতা, হাসপাতালে পড়ে থাকা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেনি। বরং আমাদের রিপোর্টাররা গিয়ে দেখেছেন, সন্তানের মত করে আগলে রেখেছে সে রুবেলকে।

শেষ সময়টা পর্যন্ত রুবেলের কণ্ঠের সেই বিনয়টা, সেই মাধুর্যটা, সেই ভালোবাসাটা ছিলো। মৃত্যুর ক’দিন আগেও ফোনে কথা হয়েছিলো। তখন তার মানুষ চিনতে কষ্ট হয়, কথা বলতে কষ্ট হয়। চৈতী ফোন ধরে বলতেন, তোমার দেবুদা ফোন করেছে। এর মধ্যেও রুবেল বলতেন, ‘দাদা, দোয়া করবেন।’

সবাই দোয়া এবং চেষ্টা করেছেন। ক্রিকেটাররাও হাল ছাড়েননি, কর্মকর্তারা পাশে ছিলেন। আমাদের কামাল ভাই (তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল) রুবেলকে দেখতে ছুটেছিলেন হাসপাতালে। কিন্তু কিচ্ছুতে কাজ হয়নি।

আমাদের দোয়া স্রষ্ঠা শোনেননি। ভালোবাসেন বলেই হয়তো ছেলেটাকে কাছে নিয়ে গেছেন।

রুবেল, ভাই আমার। বড্ড মিস করি আপনার সাথে গল্প করা। বড্ড মিস করি আপনার ক্রিকেট। যেখানে আছেন, ভালো থাকবেন রুবেল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়া সাংবাদিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *