■ তন্ময় কবির ■
লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন ছিলো একটা আপাদমস্তক আর্ট!
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির পাকিস্তান আমলের ট্রেডিশনাল ট্রেনিং ডকট্রিন আর ব্যাটালিয়ন ট্রেডিশন, শুরু থেকেই আমার কাছে ভালো লাগেনি। স্ট্রিক্ট হার্ড রুলস রেগুলেশন মেনে চলতে বাধ্য হলেও রং দেখলে, সুর পেলে আমি নরম হয়ে যেতাম,আর্ট দেখলে থমকে দাড়াতাম৷
কোভিডের সময় ক্যাডেট ডর্মিটরিতে যখন আমরা আটকা তখন কোনো এক জুনিয়র কে বাশি সহ দেখে ডেকে সিনিয়রিটি ফলিয়ে বাশি কেড়ে নেই। শখ জাগে এই একটা নতুন জিনিস শিখতে হবে৷ কিন্তু বাশি শেখা আমার মতন মানুষের জন্য সহজ না৷ বাশিতে ফু মেরে আওয়াজও বের করতে পারতামনা। সামনের রুমে জুনিয়র কোর্সের অফিসার ক্যাডেট হামীমের কাছ থেকে মোটামুটি আওয়াজ বের করা শিখলেও সুর আর উঠতোনা বাশিতে। হামীম নিজে আমার হাত থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য তানজিম নামের ওর এক কোর্সমেটের নাম বলে যে নাকি ভালো বাশি বাজানো শেখাতে পারে। কিন্তু এই তানজিমকে ফলিনের পর ফলিন দিয়েও খুজে পাইনা আর৷
সৌভাগ্যক্রমে কোনো একটা ঘাপলা মেরে এই তানজিম আমার কাছেই ধরা খায়, যখন বুঝতে পারি যে এটাই সেই বান্দা তখন তানজিম আর যাবে কই!
শুরু হয় আমার বাশি প্রশিক্ষন। যেই বাশিটা আমার হাতে এসেছিলো, সেটা নাকি তানজিমেরই বাশি ছিলো। ধীরে ধীরে তানজিমের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। স্যার থেকে ভাই হয়ে যাই নির্জনের৷ আমি আবার বিএমএতে আমার কাছের মানুষদের তাদের বাসার ডাকনামে ডাকতাম ৷ বাশি টাশি বাদ দিয়ে আমরা আড্ডা মারতাম। ক্যাডেট ডর্মিটরির যেই জায়গা থেকে সমুদ্র আর পাহাড় একসাথে দেখা যায়, সেটাই ছিলো আমাদের আখড়া। আমিই সবাইকে চিকেনফ্রাই খাওয়াই দিয়া ওই জায়গার নামকরণ করছিলাম ককপিট।
৭৯র এম ফয়সাল, ৮১র রেদু, ফাইজুল, ফাইয়াজ, ৮২র আজমাইন, তানজিম, রিফাত আরও কিছু চিল পাবলিক আমরা একসাথে বসে জ্যামিং করতাম৷ আহা কি আড্ডা গান গল্প! বিএমের মতন জায়গায় এরকম কিছু কেউ চিন্তা করতেও পারেনা। কিন্তু সিঙ্ক্রোনাইজেশন অব আইডিওলজির কারনে আর কোভিডের কারনে হয়ত এরকম অসম্ভব সম্ভব হয়েছিলো।
রাত ১/২ টার দিকে হুটহাট তানজিমের আগমন হত, এসে বলতো চলেন ভাই আমাদের জায়গায় গিয়া বসি, পোলাপান ডাকতিছি। ওই একটা জায়গায় বসে সারারাত ধরে এই গ্রুপটা আমরা প্রেম, রাজনীতি, ভূত, এক্সারসাইজ আরও যত্তসব আজগুবি গল্প আছে এসব করতাম। আমি বেশি সিভিল টাইপ হওয়াতে জুনিয়র পোলাপান গুলা আমার কাছে আসতো, কষ্টের কথা বলতো, কান্নাকাটি করতো। আমিও লিসেনিং ইয়ার হয়ে ওদের এই জায়গাটুকু দিতাম। হাসতাম, হাসাতাম, বাংলায় কথা বলতাম। পকেটে সবসময় কিটক্যাট, সাফারি থাকতো, ফার্স্ট টার্ম ক্যাডেট সামনে পাইলে পকেটে ঢুকায় দিতাম৷
এই সেম টাইপ জিনিস করতো তানজিম। গান গাইতো, বাশি বাজাইতো, আমার কাছে এসে বসে থাকতো৷ চলে যাইতে বললেও যাইতোনা৷ আমাকে বলতো, ” তন্ময় ভাই আপনি মিয়া নিজের মানুষ, আপনার কাছে আসলে মনে হয় ভার্সিটিতে পড়ি! বাইরে না থাকার দু:খ ভুলে যাই!”
সুন্দর ছবি আকতো তানজিম। সুন্দর করে কথা বলতো। মাথা কাজ না করার যেই মিলিটারি ব্যাপারটা, এইটা ছিলোনা ছেলেটার৷ ম্যাচিউর চিন্তাভাবনা সবসময়৷ আমার ঠ্যাং ঠুং অকেজো হবার পর যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে ৪/৫ মাস পর আমার মিলিটারি লাইফ শেষ তখন এই তানজিম হয়ে গেলো আমার লিসেনিং ইয়ার৷ ৮৩ লং কোর্সের প্যালেস্টাইন ক্যাডেট জিদান ও জয়েন করলো এই গ্রুপে৷ ফিউচারে কে কবে কিভাবে আমরা দেখা করবো, বাচ্চা কাচ্চাদের কিভাবে বন্ধু বানায় দিবো এগুলা আলাপও বাদ রাখেনাই৷ আমি যেদিন বিএমে থেকে চলে আসবো তার আগের দিন রাতে আমার রুমে এসে আমাকে জড়ায় ধরে বাচ্চার মতন ভ্যা ভ্যা করে কান্না করলো তানজিম৷ আমার ডাঙড়ি আর কিছু উপন্যাস এর বই নিয়ে গেলো স্মৃতি হিসেবে রাখবে বলে৷
কমিশনের পর ঢাকা এসে আমার সাথে দেখা করলো মিরপুরে৷ ওর ইউনিটের স্যুভেনির নিয়ে আসছে, একটা ওয়ালেট। আমি ওরে বললাম যে ওরে দেওয়ার মতন আমার কিছু নাই। তানজিম বলে, “একদিন এই ওয়ালেট ভর্তি টাকা দিয়েন, বাইক কিনবো”। প্রেমে পড়ছে তানজিম। প্রেমিকার সাথে পরিচয় করায় দিলো। দায়িত্ব দিয়া গেলো যেন আমি বিউপিতে ওর প্রেমিকার যেকোনো প্রয়োজনে সাপোর্ট দিতে পারি। এত সুইট আর সুন্দর কাপল আমি নিজের চোখে আর দেখিনি৷ ওদের নিয়ে বই লিখলে বেস্টসেলার উপন্যাস হয়ে যাবে একটা ।
বিশাল হোমসিক ছিলো নির্জন৷ আঙ্কেল অসুস্থ ছিলো মাঝখানে, সেইটা নিয়ে কত চিন্তা৷ ভবিষ্যৎ বউ বাচ্চা কখনো দূরে রাখতে চায়না, সেই প্ল্যান কিভাবে করবে সেটা নিয়াও আমাকে কল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ পারতো ছেলেটা৷ খুব সুইট সিম্পল একটা লাইফ চায়, ঝটঝামেলাহীন নির্মল আর সাধারণ একটা জীবন! আহা কি সুন্দর হাসিটা আমার ছোট ভাইয়ের। আমাকে ওর বিয়ের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দিসিলো যে যখন ওর বিয়ের সময় আসবে তখন যেন আমি সবকিছু প্ল্যান করি। সেই সৌভাগ্য টা আমার আর হলোনা৷
নির্জন আমার এই ছোট জীবনের একটা বড় গর্বের অংশ! ওর চলে যাবার পর এইকদিন কত যে আনমনে বাচ্চার মতন কেদেছি আর কত বার যে রাস্তাঘাটে, অফিসে বারবার চোখ ভিজে গেছে তা গুনে শেষ করা যাবেনা। নির্জন সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ ছিলো। আর কয়টা দিন পর হয়ত সবাই ভুলে যাবে। বারবার হয়ত আর মনেও পড়বেনা। তাই আমি এই লেখাটা রেখে দিতে চাই যেন বছরে একবার হলেও এটা পড়ে আমার ওর ওই হাসিমুখের কথা মনে হয়, যেন নির্জন প্রতিবারের মতন বলছে ” তন্ময় ভাই, আপনি মিয়া নিজের লোক কষ্ট বুঝলেননা! “