স্মরণ: বাংলাদেশে বাঁহাতি স্পিনের পথিকৃত গোয়ালা

:: দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ::

মোহাম্মদ রফিক, আবদুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে তাইজুল কিংবা ইলিয়াস সানি। বাংলাদেশ যেন বাঁহাতি স্পিনারের এক অফুরন্ত ভূমি। যেদিকে চোখ যায়, বাঁহাতি স্পিনার। কিন্তু এই অনন্ত স্রোতের শুরু কোথায়?

ষাটের দশকে এই বাংলাদেশে প্রথম বাঁহাতি স্পিন শুরু করেছিলেন যে জন দুয়েক স্পিনার, তারই একজন ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য রামচাঁদ গোয়ালা। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের এক জীবন্ত ইতিহাস, ময়মনসিংহের ক্রিকেটার তৈরির কারিগর রামচাঁদ গোয়ালা।

ময়মনসিংহের এক সহকারী পোস্ট মাস্টারের ছেলে ছিলেন রামচাঁদ। শুরুতে বাঁহাতি পেসার ছিলেন। পরে ফকরুদ্দিন নামে এক কোচের পরামর্শে পণ্ডিতপাড়া মাঠে বাঁহাতি স্পিন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকার ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়। টানা পাঁচ বছর খেলার পর ফিরে যান নিজের শহরে। বাবার মৃত্যুর পর হয়ে গিয়েছিলেন গৃহমুখী। কেউ বলতেন ময়মনসিংহ তাকে এতই টানত যে, ঢাকায় এসে থাকতে পারতেন না। ফলে ক্যারিয়ারের শীর্ষ সময়টাতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত একরকম ক্রিকেট থেকে দূরেই ছিলেন। তাকে ঢাকায় ফেরাতে চেয়েছিলেন শেখ কামাল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দল নিয়ে ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন শেখ কামাল। সেই দলের বিপক্ষে খেলেছিলেন রামচাঁদ। সেখানে ৬ উইকেট নিয়ে নেন। আর তার পারফরম্যান্স দেখে শেখ কামাল তাকে পরের মৌসুমে আবাহনীতে খেলার জন্য বলে আসেন। কিন্তু এর মধ্যেই আসে ১৫ আগস্টের ভয়াল রাত। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিহত হন শেখ কামালও। ফলে সে সময় আবাহনীতে খেলা হয়নি। পরে ১৯৮১ সালে আহমেদ সাজ্জাদুল ইসলাম ববি নিয়ে আসেন তাকে আবাহনীর তাঁবুতে। আর শেখ কামালকে দেওয়া কথা রাখতেই যেন এরপর টানা ১৫ বছর তিনি আবাহনীর হয়ে খেলে গেছেন; হয়ে উঠেছেন আবাহনীর প্রতীক।

৫৩ বছর বয়সেও ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন। প্রবীণরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ৪০ পার করেও দিব্যি দলকে জেতানো সব পারফরম্যান্স করেছেন রামচাঁদ গোয়ালা। সে সময় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলত না বললেই চলে। যখন বাংলাদেশ সেই অঙ্গনে পথচলা শুরু করেছে, তত দিনে রামচাঁদ নিজের সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা আইসিসি ট্রফি খেলা হয়নি। তবে জাতীয় দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা, এমসিসি ও পশ্চিম বাংলা দলের বিপক্ষে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছেন।

নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে খেলা ছাড়ার পর চলে যান আবার নিজের শহরে। সেখানে ক্রিকেটার তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাইফুল, সানোয়ারসহ অনেকেই তার কাছেই হাতেখড়ি হয়েছে।

শেষ জীবনটা খুব অভিমানে কাটিয়েছেন। ক্লাব বা বোর্ডের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজখবর রাখা হতো না। ফলে একটু অনাদর আর অবহেলাতেই শেষ পর্যন্ত এই জগতটা ছেড়ে গেছেন রামচাঁদ গোয়ালা।

২০২০ সালের ১৯ জুন পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন এই বাহাতি স্পিনার। যাওয়ার আগে লম্বা লিগাসি রেখে গেছেন।

রামচাঁদ গোয়ালার জন্য প্রার্থনা রইলো।

লেখক:  ক্রীড়া সাংবাদিক, কিশাের ফ্যান্টাসি ও ক্রীড়া ঔপন্যাসিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *