■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
প্রগতিশীল বাম ধারার বুদ্ধিজীবী, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, অধ্যাপক যতীন সরকার মারা গেছেন। বুধবার বিকাল পৌনে ৩টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। এর মধ্যে গত জুন মাসে পড়ে গিয়ে উরুর হাড়ে আঘাত পান। তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহে নেওয়ার পর সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী বলেন, “যতীন সরকার আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। উনার তো কিডনি জটিলতা ছিল। এর আগে কোভিডেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। মাসখানেক আগে কিছুটা ভালো বোধ করায় বাড়ি ফিরে যান। আজকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে মারা গেছেন।”
গত জুন মাসে ঢাকার একটি হাসপাতালে যতীন সরকারের অস্ত্রোপচার হয়। এর পর থেকে বেশির ভাগ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি কিডনিসংক্রান্ত জটিলতাসহ বাধ্যর্কজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
যতীন সরকার দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ উদীচীর ময়মনসিংহ কার্যালয়ে নেওয়া হবে। পরে কফিন নিয়ে যাওয়া হবে তার নেত্রকোণার বাড়িতে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ সম্পাদক শেখ বাহার মজুমদার জানান, হাসপাতাল থেকে যতীন সরকারের মরদেহ জেলা উদীচী কার্যালয়ে নেওয়া হবে। সেখানে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নেত্রকোনায় নিজ বাড়িতে তাঁর মরদেহ নেওয়া হবে। সেখানে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে।
১৯৩৬ সালের ১৮ অগাস্ট নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে যতীন সরকারের জন্ম। আর্থিক অনটনের কারণে শিক্ষা জীবন টেনে নিতে কৈশোর থেকেই তাকে টিউশনসহ নানা কাজে যুক্ত হতে হয়েছে।
নেত্রকোণা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ছাত্রসংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন যতীন। পরে ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহে গিয়ে ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে।
বিএ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন নেত্রকোণার আশুজিয়া হাইস্কুলে। বারহাট্টা সিকেপি পাইলট হাই স্কুলেও পড়িয়েছেন কিছুদিন। পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়তে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেখান থেকে এমএ পাস করে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাই স্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যতীন সরকার। ১৯৬৪ সালে বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে।
১৯৬৭ সালে কানন আইচের সঙ্গে যতীন সরকারের সংসার জীবনের শুরু হয়। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে তাদের।
যতীন সরকারের জীবনের বেশিরভাগ সময় ময়মনসিংহেই কেটেছে। ঊনিশশ ষাটের দশক থেকে ময়মনসিংহ শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। পরে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
পঞ্চাশের দশকে কমরেড জ্যোতিষ বোস ও অজয় রায়ের কাছ থেকে মার্কসবাদের দীক্ষা পাওয়া যতীন সরকার ২০০৭ সালে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলেন। ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন তিনি।
ময়মনসিংহে তার ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও একজন মানবতাবাদী লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাম্যবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে তিনি গুরুত্ব পেতে শুরু করেন ১৯৯০ এর দশকে।
১৯৮৫ সালে তার প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ যখন প্রকাশিত হল, বয়স তখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে।
২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃতু-দর্শন’ যতীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘বাংলাদেশী কাবি গান’।
‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘সাহিত্য নিয়ে নানাকথা’ তার প্রকাশিত আড়াই ডজন বইয়ের অন্যতম।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ বই ‘প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা’।
তার লেখায় পুরান আর দর্শন মিলে মিশে গেছে, রবীন্দ্র-নজরুলের মানবতাবাদ আর মার্কসবাদকে তিনি মিলিয়েছেন লৌকিক জীবনের সঙ্গে।
তার রচনায় রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ যেমন আছে, তেমনি আছে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যকে নতুন করে উপস্থাপনের সফল প্রচেষ্টা।
২০০৮ সালে তিনি গবেষণা ও প্রবন্ধের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০১০ সালে সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
এছাড়া ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।
চার দশকের বেশি সময় শিক্ষকতা করার পর ২০০২ সালে নাসিরাবাদ কলেজ থেকে অবসরে যান যতীন সরকার। ২০০৫ সালে স্ত্রীকে নিয়ে নিজ জেলা নেত্রকোনায় ফিরে যান। শহরের সাতপাই এলাকার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই তার শেষকৃত্য হবে।