রাইন: নাম, নদী, গল্প এবং কিছু অব্যক্ত অনুভূতি

এম সাইদুজ্জামান সানি

আজ থেকে আট বছর আগে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি কোনো শিশুর নাম রেখেছিলাম। একটি নাম – যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ব্যক্তিগত অনেক আবেগ ও অনুভূতি। ২০১৪ সালে, জার্মানির লাইপজিগ শহর ছেড়ে আমি যখন এক নতুন শহরে পাড়ি জমাই, তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন নিজেকে পিছনে ফেলে যাচ্ছি। কারণ, জার্মানিতে লাইপজিগ ছিল আমার প্রবাস জীবনের প্রথম শহর, যেখানে আমি তিন বছর কাটিয়েছি। এই দীর্ঘ সময়ের আবেগ, অভিজ্ঞতা, মানুষ আর মুহূর্তগুলো মিশে গিয়ে শহরটি যেন হয়ে উঠেছিল আমার আত্মার এক অংশ।

সেই প্রিয় শহরের প্রতিটি রাস্তা, লেক, পার্ক, ট্রামলাইন, কফিশপ, সকাল-সন্ধ্যা আমার স্মৃতিতে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল, যেন অজান্তেই এই শহরটা আমার খুব আপন হয়ে উঠেছিল। এখানেই আমার পরিচয় হয়েছিল কিছু অসাধারণ মানুষের সঙ্গে। খোকন ভাই, হুমায়ুন ভাই, রাকিব ভাই, বাবু ভাই, নাফিস ভাই, তানভীর, রবিন — আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলেছিলাম এক অভিন্ন প্রবাসী জীবন।

প্রাণের শহর লাইপজিগ ছেড়ে নতুন শহরে আসার কিছুদিন পর আমি “রাইন” নামে একটি নদীর প্রেমে পড়ি। আমি যে শহরে থাকতাম, নদীটি সেই শহরের বুক চিড়ে বয়ে গেছে। জার্মানিতে নদী খুব বেশি নেই, কিন্তু যে অল্প কিছু নদী আছে, জার্মানরা তাদের ভীষণ যত্ন করে। তবে আমার ধারণা, রাইন নদী একটু বেশিই ভালোবাসা পায়। শুধু সৌন্দর্যের কারণেই নয় বরং দৈর্ঘ্য, প্রবাহ এবং অববাহিকার দিক থেকেও এটি ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর একটি। জার্মানির বুক চিরে বয়ে চলা এই নদী তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। অবশ্য আমার কাছে ভিন্ন এক কারণে এই নদী গুরুত্ব বহন করে। ঐ সময়টা যখন আমার খুব মন খারাপ হতো, খুব একাকীত্ব অনুভব করতাম, তখনই আমি ছুটে যেতাম এই নদীর ধারে। পানির খুব কাছাকাছি গিয়ে বসতাম নিজের নিঃসঙ্গতার দিনগুলোতে। তখন এই নদী আমাকে সঙ্গ দিত। শুধু মন খারাপের নয়, আনন্দের দিনগুলোর সাক্ষীও ছিল এই রাইন নদী। এই নদীর তীরে একাকী বসে কত শত সূর্যাস্ত দেখেছি, তার কোনো হিসেব নেই! এই নদী যেন সবসময় আমাকে নিঃশব্দে, কিন্তু গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছিল।

আমি আর হুমায়ুন ভাই ছিলাম ফ্ল্যাটমেট। দুজনে একসঙ্গে কাটিয়েছি অসংখ্য আড্ডার মুহূর্ত, ভাগ করে নিয়েছি হাসি-কান্না আর জীবনের ছোট ছোট গল্প।

শুধু তাই নয়, লেখালেখির প্রতি প্রথম টানটাও যেন এসেছিল তার মাধ্যমেই। একদিন ফেসবুকে তার একটি লেখা পড়ে আমার মনের ভিতরও যেন লেখার একটি ছোট্ট বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল।

তেমনই, প্রবাসের সেই কঠিন দিনগুলোয় আমার জীবনের আরেক অবিচ্ছেদ্য আশ্রয়ের নাম ছিল খোকন ভাই। তিনি ছিলেন বয়সের দিক দিয়ে আমাদের সবার অগ্রজ এবং সবচেয়ে বেশি স্নেহশীল। আমরা দুজনেই হ্যান্ডবল খেলোয়ার ছিলাম। সেই জায়গা থেকেই যেন আমার প্রতি তাঁর আলাদা একটা টান ছিল। তিনি আমাকে ছোটভাইয়ের মতো সবসময় আগলে রাখতেন। সবকিছু পেছনে ফেলে যখন আমি নতুন শহরে চলে আসি, মনে হয় আমি কেবল শহর বদলাইনি, বদলে ফেলেছি একটা জীবন। নতুন শহরে এসেও মনে হত আমি যেন সেই লাইপজিগ শহরেরই সন্তান।

প্রাণের শহর লাইপজিগ ছেড়ে নতুন শহরে আসার কিছুদিন পর আমি “রাইন” নামে একটি নদীর প্রেমে পড়ি। আমি যে শহরে থাকতাম, নদীটি সেই শহরের বুক চিড়ে বয়ে গেছে। জার্মানিতে নদী খুব বেশি নেই, কিন্তু যে অল্প কিছু নদী আছে, জার্মানরা তাদের ভীষণ যত্ন করে। তবে আমার ধারণা, রাইন নদী একটু বেশিই ভালোবাসা পায়। শুধু সৌন্দর্যের কারণেই নয় বরং দৈর্ঘ্য, প্রবাহ এবং অববাহিকার দিক থেকেও এটি ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর একটি। জার্মানির বুক চিরে বয়ে চলা এই নদী তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।

অবশ্য আমার কাছে ভিন্ন এক কারণে এই নদী গুরুত্ব বহন করে। ঐ সময়টা যখন আমার খুব মন খারাপ হতো, খুব একাকীত্ব অনুভব করতাম, তখনই আমি ছুটে যেতাম এই নদীর ধারে। পানির খুব কাছাকাছি গিয়ে বসতাম নিজের নিঃসঙ্গতার দিনগুলোতে। তখন এই নদী আমাকে সঙ্গ দিত। শুধু মন খারাপের নয়, আনন্দের দিনগুলোর সাক্ষীও ছিল এই রাইন নদী। এই নদীর তীরে একাকী বসে কত শত সূর্যাস্ত দেখেছি, তার কোনো হিসেব নেই! এই নদী যেন সবসময় আমাকে নিঃশব্দে, কিন্তু গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছিল।

এই নদীর কিনারায় বসেই আমি বাংলাদেশে ফেলে আসা হৃদয়ের মানুষটির সঙ্গে কথা বলতাম। ফোনের ওপাশে সে, আর এপাশে আমি। সেইসব কথার ফাঁকে আমরা একসাথে বুনতাম অজস্র স্বপ্ন। মনের মাধুরী মিশিয়ে, জীবনের ক্যানভাসে আঁকতাম সুখের রঙিন ছবি। আমি তাকে প্রায়ই বলতাম —

“আমাদের যদি কোনো দিন সন্তান হয়, তার নাম রাখবো ‘রাইন’।”

সে হাসতো, কণ্ঠেও থাকতো এক মধুর সম্মতি। তারপর আবেগ আপ্লুত হয়ে সায় জানাতো আমার ভাবনার সাথে।

সবকিছু তখন ঠিকঠাকই চলছিল। স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছিলাম দুজনে। এমন সময় এক অজানা ছায়া নেমে এলো জীবনে। হঠাৎ কোন এক কালবৈশাখী ঝড় আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিল। চরম হতাশা আর কষ্টে থমকে গেল জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আমি কাতর হয়ে দিন কাটাতে লাগলাম।

জীবনের সেই দুঃসহ সময়ে আমি তখনো একাকী যেতাম নদীর কিনারায়। ঠিক আগের মতোই চুপচাপ বসে থাকতাম আর আনমনে তাকিয়ে থাকতাম জলপ্রবাহের দিকে। চলমান সেই নদী যেন আমাকে বারবার বলতো—

“দিক হারিয়ে ফেলে নদী কি থামে কখনো? জীবনও তো ঠিক তেমনই। বয়ে যেতে হয়।”

দুর্বিসহ ঐ সময়ের মাঝেই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ঝর্ণা আপা একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। অদ্ভুতভাবে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও শিশুটির কোনো নাম রাখা হয়নি। আমি ঝর্ণা আপাকে ফোনে জিজ্ঞেস করতাম—

“আপা, ওর কি নাম রাখলি?”

“এখনো কোন নাম রাখা হয়নি,” আপা প্রতিবারই উত্তর দিতেন।

বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দিত। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যে নামটি আমার সন্তানের জন্য পরম যত্নে এতদিন রেখে দিয়েছি, যে নামের সঙ্গে আমার জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতি জড়ানো—সেই নামটি আমি আমার ভাগ্নের জন্য রাখব।

সেই ভাবনা থেকেই আমার ভাগ্নের নাম দিলাম ‘রাইন’। আর এজন্যই হয়তো অন্য সবার চেয়ে রাইনকে আমি একটু বেশি ভালোবাসি।

আজ আমার সেই আদরের ছোট্ট ভাগ্নের জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন, রাইন মামা।

রাইন নদী যেমন চিরবহমান, তেমনি তোমার জীবনেও সুখ আর সাফল্যের ধারা চিরবহমান থাকুক। রাইন নদী যেভাবে সব বাঁধা পেছনে ফেলে বয়ে চলেছে অবিরত, তেমনভাবে তুমি সব বাঁধা, বিপত্তি, ব্যর্থতাকে অগ্রাহ্য করে দুরন্ত গতিতে জীবনকে সাফল্যের শ্রোতধারায় চলমান রাখবে—এই দোয়া রইলো।

আজ তুমি খুব ছোট। এই লেখাটি এখন তোমার বোঝার বয়স হয়নি। তবে আমার প্রত্যাশা, তুমি যখন বড় হবে, তখন কোনো একদিন হয়তো এই লেখাটি পড়বে। সেদিন তুমি তোমার ‘রাইন’ নাম রাখার পেছনের গল্প জানবে। সেদিন তুমি নিশ্চয়ই দূর দেশের রাইন নদীর তীরে বসে থাকা তোমার সেই তরুণ মামাকে গভীরভাবে অনুভব করবে।

ততদিনে নিশ্চয়‌ই পৃথিবী অনেক বদলে যাবে। তখন পর্যন্ত আল্লাহ যদি আমাকে হায়াত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন, আমি বুক ভরা আনন্দ আর গর্ব নিয়ে তোমার সাফল্য দেখবো। আর যদি আমি কালের যাত্রী হয়ে সেদিন পৃথিবী ছেড়ে দূর আকাশের তারা হয়ে যাই, তাহলে আমার না থাকা সেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই তুমি থাকো, ‘রাইন’ নদীর প্রতি তোমার মামার এই প্রেম, এই আবেগ আর অনুভূতি সেদিন তোমাকে ছুঁয়ে যাবে। হয়তো এক অদৃশ্য কারণে তুমিও সেদিন অদেখা এই রাইন নদীর প্রেমে পড়বে। দূর দেশে বয়ে চলা এই নদীটাকে সেদিন তোমারও খুব আপন মনে হবে।

এসেন, জার্মানি থেকে

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *