■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৯৮ জন। এতে আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০১ জন।
রোববার (২০ অক্টোবর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
দেশের ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং সংস্থার নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা।
নিহত ৯ হাজার ৬০১ জনের মধ্যে নারী ৬৭৭ জন, শিশু ৭২৯ জন। ২০৪১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৯২৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.৩৬ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৭.২১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১২১ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৮ জন, অর্থাৎ ১২.২৯ শতাংশ।
এই সময়ে ৮৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২৪ জন নিহত, ১২৫ জন আহত এবং ১৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৪৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২২৭ জন নিহত এবং ২২৩ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৯২৪ জন (৩৪.৩৬%), বাস যাত্রী ২৯৩ জন (৫.২৩%), পণ্যবাহী যানবাহনের আরোহী (ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ইত্যাদি) ৪২০ জন (৭.৫০%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ আরোহী ২৯৫ জন (৫.২৬%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান ইত্যাদি) ১০৯৭ জন (১৯.৫৯%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম) ২৭৮ জন (৪.৯৬%) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ১৭০ জন (৩.০৩%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৮৪৯টি (৩৩.৭১%) জাতীয় মহাসড়কে, ২১৩৪টি (৩৮.৯০%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৭১টি (১৪.০৫%) গ্রামীণ সড়কে, ৬৭০টি (১২.২১%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬১ টি (১.১১%) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন
দুর্ঘটনাসমূহের ১২০৪টি (২১.৯৫%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৩৬৯ টি (৪৩.১৯%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১৪৮টি (২০.৯২%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৬৪৯টি (১১.৮৩%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১৫টি (২.০৯%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহন (ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ড্রামট্রাক ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি তেলবাহী ট্যাংকার-বিদ্যুতের খুঁটিবাহী ট্রাক-সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাক ইত্যাদি) ২৩.১৪ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১০.২৫ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৪.৭৬ শতাংশ, মোটরবাইক ২০.৭৫ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান ইত্যাদি) ১৬.৪৯ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-টমটম) ৫.৯১ শতাংশ, বাইসাইকেল-রিকশা ২.২০ শতাংশ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১৬.৪৬ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১০,৬৭৯টি। বাস ১০৯৫, পণ্যবাহী যানবাহন (ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রলি-লরি-ট্রাক্টর-ড্রামট্রাক-সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাক ইত্যাদি) ২৪৭২, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৫০৯, মোটরসাইকেল ২২১৬, থ্রি-হুইলার ১৭৬১ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৬৩২ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম ইত্যাদি), বাইসাইকেল রিকশা ২৩৬ এবং অজ্ঞাত গাড়ি ১৭৫৮টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৩১০টি (৫.৬৫%), সকালে ১৪৬৫টি (২৬.৭০%), দুপুরে ১১০২টি (২০.০৯%), বিকালে ৮৬৫টি (১৫.৭৭%), সন্ধ্যায় ৫২৪টি (৯.৫৫%) এবং রাতে ১২১৯টি (২২.২২%)।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২১.৩৬%, প্রাণহানি ২৪.৩৬%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.৮৭%, প্রাণহানি ১৩.৮৪%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯.১০%, প্রাণহানি ২০.৪৮%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.২৭%, প্রাণহানি ১২.৬৮%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৪৫%, প্রাণহানি ৬.১০%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৮১%, প্রাণহানি ৫.৩৪%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১০.৯৩%, প্রাণহানি ১০.০৭% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.১৬%, প্রাণহানি ৭.০৭% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১১৭২টি দুর্ঘটনায় ১৩৬৪ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৩১৯টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিচিতি
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ২৩ জন, সেনা সদস্য ২ জন, বিজিবি ৬ জন, আনসার সদস্য ৮ জন, গ্রাম পুলিশ ৩ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৮৭ জন, প্রকৌশলী ১৭ জন, চিকিৎসক ১১ জন, আইনজীবী ১৩ জন, সাংবাদিক ২৪ জন, কৃষি কর্মকর্তা ২ জন, ভূমি কর্মকর্তা ১ জন, গ্যাস ফিল্ড কর্মকর্তা ১ জন, শ্রম ও কর্মসংস্থান ব্যুরো’র সহকারী পরিচালক ১ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬১ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯৬ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৩২ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ১৮৪ জন, উপজেলা চেয়ারম্যান ১ জন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য ৩ জন-সহ স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ১১৩ জন, হাফেজ ও ইমাম ১৯ জন, বাউল শিল্পী ২ জন, বিদ্যুতের কর্মচারী ২ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ৪ জন, পরিবহন শ্রমিক নেতা ৫ জন, পোশাক শ্রমিক ৪১ জন, বন প্রহরী ৪ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪৬ জন, দিনমজুর ১৫ জন, বালু শ্রমিক ১৩ জন, ধানকাটা শ্রমিক ৯ জন, চালকল শ্রমিক ৪ জন, সিএনজি মিস্ত্রি ২ জন, হকার ৬ জন, রাজমিস্ত্রি ১৭ জন, কাঠমিস্ত্রি ৯ জন, নিরাপত্তা রক্ষী ১১ জন, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৪ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ১৮ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৮৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য
দেশে বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ ২২ হাজার ৪৭৬.২৮ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। দেশব্যাপী এসব সড়কে নানা প্রকার যানবাহন যেমন বেড়েছে, তেমনি যানবাহনের গতিও বেড়েছে। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে গতির প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটছে। ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। যানবাহনের গতি ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারের উপরে প্রতি ৫ কিলোমিটার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।
ইদানিং প্রায়শ মহাসড়কে বিকল হওয়া পণ্যবাহী যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকছে। এই অবস্থায় বেপরোয়া গতির অপর যানবাহন দাঁড়ানো যানবাহনের পেছনে ধাক্কা দিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। যানবাহনের চাকা ফেটে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। চাকা ফাটার সাথে অতিরিক্ত গতির সম্পর্ক রয়েছে। সড়কে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মিত উঁচু স্পীড ব্রেকারের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে।
নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের মধ্যে জীবনবোধ ঠিকমতো কাজ করে না। পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। এজন্য পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. সড়ক এবং সড়ক পরিবহন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়া; ৯. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ১০. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১১. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. সড়ক এবং সড়ক পরিবহন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়া; ৮. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৯. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ১০. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে; ১১. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে; ১২. সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।