তালেবান সরকারকে প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতি

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■ 

আফগানিস্তানের ক্ষমতাগ্রহণকারী তালেবান সরকারকে প্রথম দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল রাশিয়া। বৃহস্পতিবার রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ ইসলামি গোষ্ঠী মনোনীত একজন রাষ্ট্রদূতকে স্বীকার করে নিয়েছে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপ আমাদের দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বিকাশে গতি দেবে।

“আমরা বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছি, বিশেষ করে জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি এবং অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলো নিয়ে। আমরা কাবুলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে এবং সন্ত্রাসবাদ ও মাদক সম্পর্কিত অপরাধের হুমকি মোকাবিলায় সহায়তা অব্যাহত রাখব।“

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই বিবৃতির সঙ্গে একটি ছবিও প্রকাশ করেছে, যেখানে নতুন আফগান রাষ্ট্রদূত গুল হাসান হাসানকে তার পরিচয়পত্র রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে রুদেনকোর হাতে তুলে দিতে দেখা যায়।

তালেবানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্স পোস্টে এই সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ’বলে বর্ণনা করেছে। এই পোস্টে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে কাবুলে রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনভের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

সিএনএন লিখেছে, রাশিয়ার এই স্বীকৃতি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে ৯ বছর যুদ্ধ করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৮৯ সালে আফগান মুজাহিদিনদের হাতে পরাজিত হয়ে মস্কো তাদের সেনা প্রত্যাহার করলে ওই যুদ্ধের অবসান ঘটে। ওই মুজাহিদিনদের একটি অংশ পরে তালেবান প্রতিষ্ঠা করে।

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর যে অল্প কয়েকটি দেশ আফগানিস্তানে কূটনৈতিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে, তার একটি রাশিয়া। এতদিন তালেবানকে যে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া ছিল, তা চলতি বছরের এপ্রিলে তুলে নেয় রাশিয়া।

যদিও চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তালেবানের রাষ্ট্রদূত রয়েছে এবং কাতারে তাদের একটি পুরনো রাজনৈতিক দপ্তরও রয়েছে; তবে এই দেশগুলো এখনো তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

স্বীকৃতির এই ঘাটতি অবশ্য আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ২০২৩ সালে চীনের একটি কোম্পানি তালেবানের সঙ্গে তেল উত্তোলন চুক্তি করে।

তালেবানের এখন লক্ষ্য হল, তাদের আরেক সাবেক প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন। ২০২৫ সালের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর ওই প্রচেষ্টা গতি পেয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। গত মার্চে আফগানিস্তান থেকে দুজন আমেরিকান মুক্তি পায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তিন তালেবান কর্মকর্তার মাথার দাম ঘোষণা করে দেওয়া নোটিস সরিয়ে নেয়।

তালেবান ও মার্কিন প্রতিনিধিদের আলোচনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা গত এপ্রিলে সিএনএনকে জানান, তালেবান যুক্তরাষ্ট্রে একটি দূতাবাসের মত অফিস খোলার প্রস্তাব দিয়েছে।

আমেরিকান বন্দির মুক্তির প্রশ্নে মার্চে এক বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা তালেবানকে বলেন, “আপনাদের খোলামেলা হতে হবে এবং কিছুটা ঝুঁকি নিতে হবে। এটা করুন, এতে ভালো সম্পর্কের দরজা খুলে যেতে পারে।”

সিএনএন লিখেছে, তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক যোগাযোগ সেটাই প্রথম নয়। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, যাতে ২০২১ সালের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম গ্রীষ্ম যখন কাটছিল, তখন বিশৃঙ্খলভাবে সেই চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটে, ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তালেবানকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের মিত্র’ বলে আখ্যা দেন। এপ্রিল মাসে রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত তালেবানের ওপর থেকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা তুলে নেন।

এই পদক্ষেপের ওপর ওয়াশিংটনের নজর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মার্কিনিরা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোটি কোটি সম্পদ জব্দ করেছে এবং তালেবানের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে আফগানিস্তানের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে এই গোষ্ঠী। দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে মার্কিন বাহিনী পাহারা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলে ওই সরকার এক দিনও টিকতে পারেনি।

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে ব্যর্থতা বলে অভিহিত করেছিল মস্কো। তখন থেকে তালেবান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নেন ভ্লাদিমির পুতিন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অংশীদার এবং মিত্র হিসেবে আফগানদের মূল্যায়ন শুরু করে।

২০২২ ও ২০২৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার একটি প্রধান অর্থনৈতিক ফোরামে তালেবান প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। গত অক্টোবরে মস্কোতে এই গোষ্ঠীর শীর্ষ কূটনীতিক রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে দেখা করেন।

২০১৮ সাল থেকেই তালেবানের প্রতিনিধিরা নিয়মিত মস্কো সফর করে আসছেন।

রাশিয়া ২০২২ সালে আফগানিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক একটি অর্থনৈতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী, আফগানিস্তানকে তেল, গ্যাস এবং গম সরবরাহে সম্মত হয় তারা। এমনকি তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পরও কাবুলে দূতাবাস বন্ধ না করা দেশগুলোর অন্যতম ছিল রাশিয়া।

টেলিগ্রামে এক বার্তায় কাবুলে রুশ দূতাবাস জানায়, আফগানিস্তানের সঙ্গে সংলাপ সম্প্রসারণ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান কাবুলে দূতাবাস চালু রাখলেও, তারা এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতও কূটনৈতিক আলোচনা করলেও সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে, তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করল।

১৯৭৯ সালে, যখন হাজার হাজার প্রাক্তন সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানের বামপন্থি সরকারকে সমর্থন করার জন্য কাবুলে যায়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আফগান মুজাহিদিনদের সাথে দীর্ঘ যুদ্ধে ১৫ হাজারের মতো সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয়। পরে ১৯৮৯ সালে, সোভিয়েত বাহিনীগুলো আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *