:: ক্রীড়া প্রতিবেদক ::
সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টা পর অসুস্থ হয়ে সাফজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া খাতুন মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২১ বছর।
বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামে বাবার বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
বুধবার রাত ১০টার দিকে বাবার বাড়িতে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন রাজিয়া। তিনি ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন।
রাজিয়ার ভাই মো. ফজলুল হক তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নাগরিক নিউজকে নিশ্চিত করেছেন।
ফজলুল হক নাগরিক নিউজকে বলেন, ২০২০ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাই এলাকার একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ইয়াম রহমানের সঙ্গে তাঁর বোন রাজিয়ার বিয়ে হয়। গতকাল রাত ১০টার দিকে বাবার বাড়ি লক্ষ্মীনাথপুরে স্বাভাবিকভাবে রাজিয়া একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান জন্মের পর রাজিয়া সুস্থ ছিলেন। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত সাড়ে তিনটার দিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
ফজলুল হক আরও বলেন, দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রাজিয়া সবার ছোট। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব–১৯ জাতীয় নারী ফুটবল দলে খেলেছেন। এর আগে বয়সভিত্তিক দলে দেশে ও দেশের বাইরে ভারত, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কারও নিয়েছেন। তিনি বলেন, কালীগঞ্জ উপাকুড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে রাজিয়ার সুখ্যাতি বাড়ে। পরে কুশুলিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি ফুটবল অনুশীলন করতেন।
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন গোলাম রব্বানী ছোটন। তাই রাজিয়াকে খুব কাছ থেকে চেনেন দেশের নামি এই কোচ। রাজিয়ার মৃত্যুর খবরে স্মৃতিচারণ করে ছোটন বলেন, ‘২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে রাজিয়া খেলেছিল। পরের বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ভুটানের চ্যাম্পিয়ন দলেও ছিল। সিনিয়র দলে ক্যাম্পও করেছে কিছুদিন। পারফরম্যান্সে অবনতির কারণে ২০১৯ সালের দিকে ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে।’
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের প্রেক্ষাপটে বাফুফের ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ার পর আবার ফিরে আসা কঠিন। লিগ অনিয়মিত এবং এতদিন ফিটনেস ধরে রাখাও কষ্টকর। ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ার পরেও রাজিয়া ফুটবলের সঙ্গে ছিলেন। এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কাচারিপাড়া দুই দলে গত দুই লিগ খেলেছিলেন তিনি। এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দলের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন জুবায়ের বলেন, ‘এক মৌসুম আগে লিগে আমাদের দলে খেলেছে রাজিয়া। সাতক্ষীরায় তার বাড়ি। আমাদের সাবেক খেলোয়াড়ের এমন মৃত্যুতে আমরা খুবই ব্যথিত। ’
রাজিয়ার স্বামী ইয়াম রহমান নাগরিক নিউজকে বলেন, তাঁর বাড়ি রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার পাম হাউস গ্রামে। তিনি অনূর্ধ্ব–১৬ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। পরে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে অনূর্ধ্ব–১৮ দলে খেলেন। তখন রাজিয়ার সঙ্গে পরিচয়। তিন বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। তিনি বলেন, হাসপাতালে ডেলিভারি করানোর জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তিনি টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি না করে বাড়িতে রেখে ডেলিভারি করায় রক্তক্ষরণে তাঁর স্ত্রী মারা যান।
রাজিয়ার মা আবিরণ বিবি বলেন, রাজিয়া অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চাইতেন না। অন্তঃসত্ত্বা থাকতে ইতিয়ারা পারভিন নামের এক পরিবার পরিকল্পনা কর্মী তাঁকে ডেকে একটি ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তেমন কোনো চিকিৎসা নেওয়া হয়নি। তাঁর দাবি, স্থানীয় এক ধাত্রী তাঁকে প্রসব করান। স্বাভাবিকভাবে প্রসব হয়। রাজিয়া ও সন্তান সুস্থ ছিল। হঠাৎ রাজিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
মৌতলা ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কর্মী ইতিয়ারা পারভিন জানান, কয়েক মাস আগে এক দিন তাঁদের ক্যাম্পে এসেছিলেন রাজিয়া। তাঁকে গর্ভকালীন টিকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক সঞ্চয় মণ্ডল বলেন, বুধবার রাত ১১টার দিকে তিনি বাড়িতে গিয়ে দেখেন, মা ও সন্তান সুস্থ। রাজিয়া পেটে ব্যথার কথা বলেছিলেন। তিনি ব্যথানাশক বড়ি দিয়ে বাড়িতে চলে যান। রাত তিনটার দিকে ফোনে খবর পেয়ে এসে দেখেন রাজিয়া অচেতন। তখন জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
হাসপাতালের প্রসূতিবিশেষজ্ঞ ফারাহানা ইসলাম জানান, প্রসবের পর সাধারণত রক্তক্ষরণ বেশি হলে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারে।
কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদি নাগরিক নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের পর রাজিয়ার জানাজা বাড়ির পাশে একটি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া রাজিয়া বাংলাদেশের নারী ফুটবলের উত্থানের শুরুর দিকের একজন। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ রিজিওনাল (সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ এশিয়া) চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১৩ ও ১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন দলে ছিলেন তিনি৷ এরপর অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলেছেন।