■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম। মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন।
এই মামলায় আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য কোনো মামলা না থাকলে আজহারুলকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন।
আদালতে আপিলকারীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মো. রায়হান উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম শুনানিতে অংশ নেন।
জামায়াত নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, জামায়াতের ঢাকা উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, মাসুদ সাঈদী, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাস নিয়ে আপিল বিভাগের রায় প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আদালতের এই রায়কে তারা মেনে নিয়েছেন এবং এতে আপত্তির অবকাশ নেই।
তিনি বলেন, ‘এই মামলা যেহেতু রিভিউ থেকে আপিলে এসেছে, তাই এর ওপরে বাংলাদেশের আর কোনো আদালত বা আন্তর্জাতিক ফোরাম নেই। এই রায়ের মাধ্যমে বর্তমান বিচারপদ্ধতি আরও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে আর প্রশ্ন তুলতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি, যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তাই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধের সংজ্ঞা এবং কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মতো বিষয়ের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। না হলে যে সমালোচনা আগে আমরা ট্রাইব্যুনালের রায়ে করেছিলাম, যে সেটি আন্তর্জাতিক মানসন্ধান পূরণ করে না, তা থেকেই যাবে।’
প্রসিকিউটর তামিম বলেন, ‘আমরা যেদিন প্রসিকিউশনে যোগ দিয়েছি, সেদিনই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে আজ যখন আপিল বিভাগ বলেছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা এখানে প্রয়োজনীয়—আমরা তাতে একমত এবং এই রায়ের পক্ষেই আমরা রয়েছি।’
তিনি জানান, মামলার মূল যুক্তিগুলো (মেরিট) আদালতে উপস্থাপন করা হয় এবং সেগুলোর ভিত্তিতে আদালত আসামিকে খালাস দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর কোনো অবকাশ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে গাজী তামিম আরও বলেন, ‘আমাদের দাখিল করা আবেদনে কিছু ক্লারিক্যাল ভুল ছিল, যা সংশোধন করে নতুন একটি আবেদন দাখিল করা হয়। সেখানে আমরা পরিষ্কারভাবে বলি, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় ও বিচার নিয়ে আপিল বিভাগ যেন ন্যায়বিচারের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন। সেক্ষেত্রে যেকোনো আদেশ দিলে আমরা তা মেনে নেব। আমরা ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যৎ বিচার ও বর্তমান কাঠামোর বিপক্ষে কোনো কিছু বলিনি, এমনকি কোনো আবেদনও দেইনি।’
সকাল সাড়ে ১১ টায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংবাদ সম্মেলনে রায় নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এটিএম আজহারের রায় সুবিচার হয়েছে। মহান রবের দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদুলিল্লাহ।’
তিনি আরও বলেন, জুলুম করে দলটির ১১ জন শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজানো পাতানো আদালত এবং মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে কার্যত জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, এ টি এম আজহারের মুক্তি না হওয়ায় তাঁরা বিস্মিত এবং ব্যথিত।
তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর যাঁরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাতে অন্যায়ভাবে আটক ছিলেন, অন্যায় বিচারে যাঁদের ফাঁসি হয়েছিল, প্রায় সবাই মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের মজলুম নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই, তা আইনজীবীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার পরও আট মাস পার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনজীবী ও কোর্টের কাছে ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু সারা দেশে আমাদের লক্ষ-কোটি নেতাকর্মী যাঁরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন, তাঁরা ব্যথিত। তবে আমরা হতাশ নই। কারণ আমরা মনে করি, আদালত সুবিচার করবেন। আমরা ধৈর্য ধরব। আমরা আদালতের নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
এই মামলায় আপিলের ওপর শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে তারিখ ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিলটি রায় ঘোষণার জন্য আজকের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। আসন গ্রহণের পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
সকাল ৯ টা ৫০ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচরপতি এজলাসে উঠেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজি এমএইচ তামিম আইনি বিষয় তুলে ধরেন। এরপর রায় ঘোষণা শুরু হয় ৯টা ৫৫ মিনিটে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহারুল। এই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল।
এই পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সংক্ষিপ্তসার জমা দিতে বলা হয়। পরে আপিলের সংক্ষিপ্তসার জমা দেওয়া হয়। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে আজ রায় দিলেন আপিল বিভাগ।
এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের।
রায় ঘোষণার পর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আসিফ নজরুল লেখেন, ‘নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তাঁর করা রিভিউ সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ।’
আইন উপদেষ্টা আরও লেখেন, ‘আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে আজকের রায়ে। এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গন-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। এই সুযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।’