■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
বাংলাদেশি আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে অপহরণ করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। বুধবার স্থানীয় সময় সকালে ইসরায়েলি নৌবাহিনী তাঁকে কনসেন্স (Conscience) নামের একটি নৌযান থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
বুধবার সকালে শহিদুল আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা এক ভিডিও বার্তায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লিখেন, ‘আমি শাহিদুল আলম, বাংলাদেশের একজন ফটোগ্রাফার ও লেখক। আপনি যদি এ ভিডিওটি দেখেন, তাহলে বুঝবেন আমরা সমুদ্রে বাধা পেয়েছি এবং আমাকে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী অপহরণ করেছে।’
শহিদুল আলম আরও বলেন, ‘ইসরায়েল গাজার মানুষদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে, যেটিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে। আমি আমার সব সহকর্মী ও বন্ধুদের অনুরোধ জানাই—প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যান।’
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, দেশটির নৌবাহিনী শহিদুল আলমকে বহনকারী নৌযান কনসেন্সসহ ফ্লোটিলার সব নৌযান আটক করেছে। টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব জানিয়েছে, গাজার সমুদ্র অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করা নতুন একটি নৌবহরকে তারা থামিয়ে দিয়েছে। ফ্লোটিলার নৌযান ও যাত্রীদের আটক করে ইসরায়েলি বন্দরে নেওয়া হচ্ছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছে, ‘আইনসিদ্ধ নৌ অবরোধ ভাঙা ও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের আরেকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা শেষ হলো। নৌযান ও যাত্রীদের ইসরায়েলি বন্দরে নেওয়া হচ্ছে। সব যাত্রী নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। তাঁদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানো হবে।’
এর আগে বাংলাদেশ সময় আজ সকাল ৯টার কিছু পরে শহিদুল আলম তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখেন, ‘ইসরায়েলিরা কনসেন্সের দিকে এগিয়ে আসছে।’ আরেক ভিডিও ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘ইসরায়েলিরা এগিয়ে আসছে।’
জাহাজটি থেকে করা ফেসবুক লাইভে সমুদ্রের আকাশে বিমানটিকে দেখা যায়। লাইভটি করেন অধিকারকর্মী উইলিয়াম আলেকজান্ডার। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের চারপাশে কয়েকবার ঘোরার পর একটি বড় সামরিক বিমান এইমাত্র সরাসরি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। নিঃসন্দেহে এটা অপ্রয়োজনীয়। তারা আমাদের ওপর একটি চক্কর দিয়েই সম্ভবত সব তথ্য সংগ্রহ করতে পারত। এরপর তারা থাউজেন্ড ম্যাডলিন ফ্লিটের দিকে চলে গেছে। সম্ভবত তথ্য সংগ্রহের জন্য এ কাজ করেছে তারা। আমার ধারণা, তারা আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।’
বিমানটি উড়ে যাওয়ার সময় লাইভ ভিডিওতে কনসেন্সের আরেক যাত্রী সতর্কবার্তা দেন, ‘সতর্ক থাকুন। খুব ধীরে ধীরে এগোবেন। স্বাভাবিক থাকুন। তাদেরকে আমাদের সঙ্গে খেলতে দেবেন না।’ পরে উইলিয়াম জাহাজের ভেতরের ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জাম দেখিয়ে বলেন, ‘আমার পেছনে প্রচুর ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম রয়েছে। এগুলো আমরা কনশানস জাহাজে করে গাজায় নিয়ে যাচ্ছি।’
জাহাজের ক্যাপ্টেন ম্যাডেলেইন হাবিব বলেন, ‘আমি সত্যিই আশা করছি, এবার আমরা গাজায় পৌঁছাব। সত্যিকারে একটি শান্তি প্রক্রিয়ার আশা করছি এবং আমাদের আটকানো হবে না। আমরা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্থায়ী করিডোর চাই, যাতে তারা সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করতে পারে।’
ভিডিওতে ওই জাহাজে থাকা মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা টম হায়েস বলেন, ‘একজন আমেরিকান হিসেবে আমাদের এখন কী করা উচিত? আমাদের অবশ্যই প্রতিটি ফোরামে ও সম্ভাব্য প্রতিটি উপায়ে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পথ সুগম হয়।’
কনসায়েন্স জাহাজটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)’ ও ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা (টিএমটিজি)’ নৌবহরের অংশ, যা গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে এবং ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে চেষ্টা করছে।
এর আগে আরেক পোস্টে তিনি ঠিক তিনি কোথায় আছেন, গাজায় পৌঁছাতে আর কত সময়ইবা লাগবে ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব দেন। শহিদুল আলম লেখেন, ট্র্যাকার ব্যবহার করে আমাদের যাত্রাপথ অনুসরণ করা সবচেয়ে ভালো উপায় হবে। ‘ফরেনসিক আর্কিটেকচার’ সাইটের মাধ্যমে কনসায়েন্স ও থাউজেন্ড ম্যাডলিনস উভয় নৌবহরের যাত্রাপথ ট্র্যাক করা হচ্ছে।
দুই বছর ধরে ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে। এ সময়ে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭০ দজনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, অনেকে আটক ও কারাগারে বন্দী আছেন।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলি নৌবাহিনী ‘সুমুদ ফ্লোটিলা’ নামের একটি নৌবহর থেকে অন্তত ৪০টি নৌযান আটক করে। গাজা অবরোধ ভাঙতে এটা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ওই অভিযানে অংশ নেওয়া ৪৭৯ জনের মধ্যে বেশির ভাগকেই আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁদের অনেককে নির্যাতনও করা হয়। পরে তাঁদের তুরস্ক, গ্রিস ও স্লোভেনিয়ায় পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও ছিলেন।
অন্যদিকে গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা তাদের সর্বশেষ আপডেটে জানিয়েছে, তাদের নৌযানগুলো ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে। গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা বেশ কয়েকটি নৌকা আটক করা হয়েছে।
ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে সংগঠনটি জানায়, ইসরায়েলি সেনারা সংকেত বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে অন্তত দুটি নৌযানে প্রবেশ করেছে তারা।
উল্লেখ্য, প্রায় ১৮ বছর ধরে গাজার উপকূলে ইসরায়েলের কঠোর সামুদ্রিক অবরোধ চলছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণবাহী জাহাজগুলো সেখানে পৌঁছাতে পারে না। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নিয়মিত এই অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করলেও, প্রায় প্রতিটি প্রচেষ্টাই ইসরায়েলি প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়েছে।
শহিদুল আলমের অংশগ্রহণে এই সাম্প্রতিক ফ্লোটিলা আটক হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের মানবাধিকার ও সাংবাদিক সমাজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শহিদুল আলমের দ্রুত মুক্তি দাবি করছে।