:: সৈকত রুশদী ::
‘মেঘ, তুমি সরে যাও। সূর্যগ্রহণকে দেখতে দাও!’ বলছিলেন এক টেলিভিশন প্রতিবেদক। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের তীর থেকে। দেখছিলাম সিটিভি চ্যানেলে।
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বিভাজক নায়াগ্রা নদী ও জলপ্রপাতের দুই তীরে সমবেত হয়েছে এক মিলিয়ন অর্থাৎ দশ লাখের বেশি মানুষ। কেবল এই দুর্লভ পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য।
দুই বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে, ১৪ মাস আগে নায়াগ্রা ফলস-এ হোটেল বুকিং দিয়ে আসা এক নারী বিপুল উৎসাহ প্রকাশ করছিলেন সেই প্রতিবেদকের কাছে।
অথচ ঘন মেঘের চাদরে ঢাকা পড়েছে আকাশ। সকাল থেকেই সূয্যি মামার দেখা নেই। সকল আশায় যেন গুড়ে বালি!
মেঘে ঢাকা টরন্টোর দিগন্ত
একই পরিস্থিতি আমাদের টরন্টো মহানগরীতেও। ফলে, দূরে কোথাও না গিয়ে বাড়ির পাশে ফ্লেমিংডন পার্ক এলাকার খেলার মাঠে যাওয়াই স্থির করলাম আমরা তিন জন।
তার আগে, কম্পিউটারে নাসা (NASA)-র ওয়েবসাইটে চলমান সম্প্রচার থেকে দেখলাম মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে সূর্যগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ের দৃশ্য। পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গেল মেক্সিকোয়, টেক্সাসসহ কয়েকটি রাজ্যে।
সূর্যগ্রহণ দুর্লভ নয়। প্রায় ১৮ মাস পরপরই সূর্যগ্রহণ ঘটে। তবে তার বেশিরভাগই মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, তা পৃথিবীর তিন ভাগ জলের উপর ঘটে বলে।
তবে পৃথিবীর একই স্থান থেকে পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণ দৃশ্যমান হতে পারে প্রতি ৪০০ বছরে মাত্র একবার। সেকারণেই এতো উৎসাহ। এতো তোড়জোড়।
আজ সূর্যগ্রহণের পূর্ণ গ্রাসের সময় ছিল আমাদের টরন্টোয় বিকেল ৩ঃ১৯ মিনিটে।
কন্যা উপল ও স্ত্রী শিউলীসহ তার মিনিট কুড়ি আগেই পৌঁছে গেলাম নিকটবর্তী খেলার মাঠে।
তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু উত্তুরে হাওয়ার কারণে বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনাবৃত নাক, কান ও মুখ জমে যাচ্ছে।
মেঘলা আকাশে সূর্য দেখার কোনো উপায়ই নেই। তবু ক্রমেই ঘন ঘোর আঁধারে ঢেকে গেল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ।
চারিদিকে পাখি ডেকে উঠলো। গাছ থেকে ডানা মেলে দিল দিগন্তে। যেন সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার তাড়া তাদের।
টের পাওয়া গেল সূর্যের আলো ও তাপের অনুপস্থিতি কীভাবে প্রভাবিত করে পৃথিবী নামের গ্রহকে। প্রাণীকুলকে।
সূর্যাস্ত পরবর্তী প্রভার মতো কাটলো তিন-চার মিনিট। পূর্ণ গ্রাস পার হওয়ার কারণে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো চারপাশ।
সূর্যগ্রহণ প্রথম দেখি মেহেরপুরে
আমার মনে পড়লো, প্রথম সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা। সাত বছর বয়সে, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের মেহেরপুরে। পৈতৃক বাড়িতে।
পিতামহ বলে দিয়েছিলেন, সূর্যের দিকে সরাসরি তাকালে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো যাবে না। বাড়ির অন্দরমহলের বারান্দায় একটি বড় পিতলের থালায় পানি রেখে সেই পানিতে আংশিক গ্রহণ লাগা সূর্যের প্রতিফলন দেখেছিলাম।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় সূর্যাস্ত ভেবে বাড়ির পোষা মোরগ-মুরগী ডাক ছেড়ে তাদের খোপে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু গ্রহণ শেষে আবার সূর্য উদ্ভাসিত হওয়ার পর তারা অবাক হয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
সাতান্ন বছর পরে আজ, ২০২৪ খ্রিস্টব্দে, মেহেরপুর থেকে প্রায় তের হাজার কিলোমিটার দূরে টরন্টোর দিগন্তে আবার সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য যথোপযুক্ত রোদচশমা সহ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। অথচ মেঘে ঢাকা দিগন্তে সূর্যের কিংবা তার গ্রহণ লাগার দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলাম।
সূর্যগ্রহণের দেখা মিললো ক্ষণিকের তরে
আজ পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণ শেষে তা’ দেখতে না পেয়ে আমিও বলতে থাকলাম, ‘মেঘ, তুমি সরে যাও। চাঁদের ছায়ায় ঢাকা সূর্যকে দেখতে দাও!’
বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ দেখি, মেঘ সামান্য সরে গ্রহণ লাগা সূর্যের এক তৃতীয়াংশ, দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো, ক্ষণিকের ঝলক দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল মেঘের আড়ালে! কন্যা উপল ও আমার চোখে ধরা পড়লো সেই দৃশ্য মুহূর্তের জন্য।
ছবি তোলার আগেই আবার মেঘে ঢাকা সূর্য ও দিগন্ত!
টরন্টো, কানাডা থেকে