একদিনেই গাজায় ফিরলেন ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি

■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দিনে হাজারো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি গাজা নগরে ফিরতে শুরু করেছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহরে ফিরে কেউ হতবাক ধ্বংসযজ্ঞে, কেউ স্বস্তি পেয়েছেন ঘর এখনও টিকে আছে জেনে।

যুদ্ধবিরতির সুযোগে রাজা সালমি নামের এক ফিলিস্তিনি নারী পায়ে হেঁটে ফিরে গেছেন গাজা নগরের নিজের বাড়িতে। কয়েক সপ্তাহের বিমান ও স্থল অভিযানে ওই অঞ্চলে তীব্র বোমাবর্ষণ হয়েছিল—যেখানে ইসরাইলি বাহিনীর দাবি অনুযায়ী হাজারো হামাস যোদ্ধা অবস্থান করছিল।

রাজার ভাষায়, ‌‘আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেছি। প্রতিটি পদক্ষেপে ভয় ও উৎকণ্ঠা ছিল—বাড়িটা আদৌ আছে কি না।’ তিনি যখন আল-রিমাল পাড়ায় পৌঁছান, দেখেন তার ঘরটি আর নেই।

‘এটা আর কোনো ঘর নয়—শুধু ধ্বংসস্তূপ। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি। আমার সব স্মৃতি এখন শুধু ধুলো,’ বলেন সালমি।

হামাস-নিয়ন্ত্রিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, শনিবার একদিনেই প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গাজা নগরে ফিরেছেন।

গাজায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলি নৃশংসতার মুখে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাইকে। এর মধ্যে গত আগস্টে গাজা নগরীতে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর পর পালিয়েছিলেন ৭ লাখ ফিলিস্তিনি। এখন যুদ্ধবিরতি ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের খবরে অনেকে আবার গাজা নগরীসহ উত্তরের এলাকাগুলোয় ফেরা শুরু করেছেন।

গাজা কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, দুই বছরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ৪ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি বা ৯২ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্কুল ধ্বংস হয়েছে ৫১৮টি। ফলে শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। ৬৫৪টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ইসরায়েলের হামলার কারণে গাজার মাত্র দেড় শতাংশ কৃষিজমি চাষাবাদের যোগ্য রয়েছে।

গতকাল মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবির থেকে ফিলিস্তিনিরা গাজা নগরীর দিকে ফিরছিলেন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দেখা যায়। মেহেদি সাকলা নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘জানি সব বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু ফিরতে পেরে আমরা খুশি। পালিয়ে বেড়াতে গিয়ে দুই বছর ধরে আমাদের কম ভুগতে হয়নি।’

সংস্থার কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-মুগাইয়ির বলেন, ‘গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট প্রায় আড়াই লাখ মানুষ গাজা নগরে ফিরে এসেছেন।’

মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে গত বুধবার হামাস ও ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। দীর্ঘ বৈঠকের শেষে গতকাল শুক্রবার ভোরে চুক্তিটির অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর (বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটা) থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর অবস্থান সরিয়ে নেবে ইসরায়েল। আর ৭২ ঘণ্টা-অর্থাৎ সোমবার দুপুর নাগাদ গাজায় এখনো বন্দী থাকা জীবিত সব জিম্মি ইসরায়েলকে ফিরিয়ে দেবে হামাস। এরপর ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেছিলেন, তার প্রথম ধাপ বলা হচ্ছে এই যুদ্ধবিরতিকে। ওই পরিকল্পনা নিয়ে সোমবার থেকে মিসরে হামাস ও ইসরায়েলের পরোক্ষ আলোচনা চলছিল। আলোচনায় যোগ দিয়েছিল ফিলিস্তিনি সংগঠন ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনও (পিএলএফপি)।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় টানা নৃশংসতা চালায় ইসরায়েল। এর মধ্যে মাত্র দুই মাসের কিছুটা বেশি সময় যুদ্ধবিরতি ছিল। বাকি সময়ে উপত্যকাটিতে নির্বিচার হামলা চালিয়ে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আহত প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। একে জাতিগত নিধন বলে গত মাসে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্রে দেখা যায়, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার অধীনে তিন ধাপে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। গত দুই বছরে উপত্যকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা দখল করে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিলে ৫৩ শতাংশ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর দ্বিতীয় ধাপে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ৪০ শতাংশ এলাকা।

শেষ ধাপে সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিলে গাজা-ইসরায়েল সীমান্ত বরাবর ১৫ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই এলাকায় ‘নিরাপত্তা গণ্ডি’ তৈরি করা হবে। হুমকি পুরোপুরি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান করবেন। তবে এই হুমকির কথা বলে সেনারা কত দিন থাকবেন, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

যুদ্ধবিরতির পর গতকাল গাজার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রথম ধাপে ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিতে দেখা যায়। উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিস, মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শরণার্থীশিবির এবং উত্তরে গাজা নগরীর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল থেকে সেনা ও ট্যাংকগুলো পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছিল।

চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে হামাসকে। তবে মৃত জিম্মিদের মরদেহ কবে নাগাদ হামাস ফেরত দিতে পারবে, তা পরিষ্কার নয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, জীবিত বা মৃত জিম্মিদের ফেরত নেওয়ার সময় আগের মতো এবার আর কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে না। গণমাধ্যমকেও এ থেকে দূরে রাখা হবে।

জিম্মিদের ফেরত দেওয়ার পর যে ১ হাজার ৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে, তাঁদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, এই ২৫০ জনের মধ্যে ১৫৯ জন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাসীন দল ফাতাহর, ৬৩ জন হামাসের, ১৬ জন ইসলামিক জিহাদের এবং ১২ জন পিএফএলপির সদস্য।

এদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরও গতকাল গাজার আকাশে দেখা গেছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার। দক্ষিণ গাজায় ট্যাংক ও কামানের গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। মধ্য গাজায় গোলাগুলির শব্দের কারণে অনেক ফিলিস্তিনিই উত্তরের দিকে নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *