দু:খিত এনসিপি, আপনাদের সমর্থন করছি না

এ কে এম জামীর উদ্দীন

দু:খিত এনসিপি, আপনাদের আমি আর সমর্থন করছি না। আপনাদের প্রতি শুরুতে এক ধরনের কোমলতা ছিল। ভালো লাগা ছিল। মুগ্ধতা ছিল।কিন্তু গত এক বছরে আপনারা ভয়াবহ রকমের বিভাজন তৈরি করেছেন বাংলাদেশে।এর জের ধরে অনেকের মধ্যেই আপনাদের প্রতি তৈরি হয়েছে ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণা। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আমার মধ্যেও সেই জিনিসটি তৈরি হবে।গোপালগঞ্জে আপনাদের রক্ষা করার কথা ছিল জনগণের। কিন্তু, মানুষ আপনাদের সঙ্গে ছিল না। আপনারা গোটা দেশের মানুষকে ফেইসবুক পোস্টে আহ্বান করেছিলেন গোপালগঞ্জ যাওয়ার জন্য। মানুষ যায়নি। আপনাদের উপর হামলা হয়েছে। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে আপনারা ছিলেন। সেখানে আপনাদের রক্ষার্থে মানব বর্ম ছিল। কিন্তু, এবার মানুষ আপনাদের রক্ষা করেনি। হামলার বিরুদ্ধে আপনারা নূন্যতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। আপনাদের রক্ষা করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান করে আপনারা পালিয়ে এসেছেন। আপনাদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে সেনাবাহিনী গুলি করেছে। আহত-নিহত হয়েছে অনেক মানুষ। দৃশ্যত, জলপাই রঙের সঙ্গে আপনাদের কোনো তফাৎ ছিল না। শুধু তাই নয়, আপনারা এখন সরকারি দলে পরিণত হয়েছেন। সরকার ও আপনাদের উভয়ের রাজনৈতিক দর্শন এতোই দুর্বল যে, নিজদের রক্ষা করার শক্তিও আপনাদের নেই। ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর থেকে আমার রাজনীতি দেখা শুরু। বাংলাদেশর কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলকে আমি এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে ময়দান থেকে পালাতে দেখিনি। কি দু:খজনক। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই আপনাদের এই জঘণ্য পরিণতি আমাদের দেখতে হচ্ছে।

আমি-আমরা আতঙ্কিত। যদি কোনো মেকানিজমের মাধ্যমে (যেভাবে আওয়ামী লীগ ২০১৪ পরবর্তী ক্ষমতায় ছিলো) এনসিপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনের মাধ‍্যমে ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে এখানকার ভবিষ্যৎ কি? এই ধরনের ঘটনায় প্রথম শিকার হবে নারী ও মুসলিম ভিন্ন অন্যান্য ধর্মের লোকজন। যে নারীরা এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের পা থেকে প্রথম ধাক্কায় ফুটবল কেড়ে নেওয়া হবে। তাদের স্থান হবে অন্দরমহলে। ইতিমধ্যেই তাদের উপর মৌলবাদী আক্রমণ আমরা দেখেছি। অন্য ধর্মের লোকজনকে বাংলাদেশে থাকতে হবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। ইতিমধ্যে তারা ঐ নিম্নশ্রেণীতেই আছেন। তখন সেটি আইনে পরিণত হবে। এখানকার হাজার বছরে গড়ে উঠা সংস্কৃতি না-ই হয়ে যাবে। এই ধরনের আতঙ্ক আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো ইসলামফোবিয়া নয়। শরিয়া প্রতিষ্ঠা হওয়া দেশগুলোর ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। আমি-আমার দেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করবো না। আমি মধ্যপ্রাচ্যের শাসন ব্যবস্থাকে ঘৃণা করি। কারণ, সৌদি বা আরব আমিরাতের রেজিম আমরা দেখছি বহুবছর ধরে। সেখানে কি হচ্ছে আমরা জানি।

৬৪ জেলায় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আপনারা গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনাদের সেই যাত্রা ছিল অন্য জেলাগুলো থেকে ভিন্ন। আপনারা এমনভাবে এই কর্মসূচি ঠিক করেছিলেন যেন আপনারা সেখানে শেখ মুজিবের সমাধিসৌধ গুড়িয়ে দিবেন। অনেকের ফেসবুক পোস্ট থেকে সে রকমই ঈঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ৩২ গুড়িয়ে দিয়ে মনে করেছিলেন, সবকিছুই কতো সহজ! স্থান ও সময় সর্বদা একই রকম থাকে না। ধানমন্ডি ৩২ ও গোপালগঞ্জ আপনাদের জন্য একই রকম স্থান নয়। একইভাবে ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি ও জুলাই এক সময় নয়। সরকারি দল হিসেবে আপনারা অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। আপনাদের মনে রাখা উচিৎ, বাংলাদেশের অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ এতো আওয়ামী দু:শাসনের পরও এখনও আওয়ামী লীগ। ১৬ বছরের দু:শাসনের কারণে বাংলাদেশে সরকারি দল মানেই আওয়ামী লীগ। ফলে ২০২৫-এর আওয়ামী লীগ হচ্ছেন এখন আপনারা। দুনিয়ার সব দেশেই সাধারণত সরকারি দলের দু:শাসন মানুষ ভুলে যায়। ২৪-এ আওয়ামী লীগের হত্যাযজ্ঞও মানুষ ভুলে যাচ্ছে। সেখানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে আপনাদের দু:শাসন। আপনাদের হত্যাযজ্ঞ! মানুষের দিকে সেনাবাহিনীর সরাসরি গুলি। এটাই হওয়ার কথা ছিল। কেননা, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের দূষিত নদীর গতিপথ বদলাতে পারেনি। ১৯৭১-এর পর থেকে এখানকার কোনো শাসকই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রত্যেকই কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দলটি ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য সব রকমের দমন-পীড়ন চালিয়েছে। আর আপনারা তো মাত্র একটি গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন। আপনাদের কাছ থেকেই গণতন্ত্র আশা করাটিই আমাদের একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। আপনারাও দুনিয়া ধ্বংসের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান। হায় ক্ষমতা! হায় গণঅভ্যুত্থান-২৪!

আপনাদের দর্শনগত মিলের কারণে আপনারা অবলীলায় জামায়াত-হেফাজতসহ অন্যান্য ডানপন্থী দলের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গেছেন। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে ডানপন্থি ধর্মান্ধরা কোথাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। শরিয়া শাসনও অনুরূপ। কারণ, নিজ ধর্মকে অন্ধভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দিলে অন্য ধর্ম সেখানে পদানত হয়ে যায়। এতে সেখানে তৈরি হয় বিভাজন। শুধু তাই নয়, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যেও শরিয়া শাসনের উপর ভর করে ঐক্যবদ্ধ কোনো রেটরিক আজকের দিন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বে দুনিয়াজুড়ে মুসলমানরা নিজেরাই জেরবার। এই দেশের ডানপন্থিদের দর্শন শুরু থেকেই এখানকার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এখানকার সংস্কৃতি মানেই বাংলা, বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের ৭১ ও এর চেতনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পতাকা। আপনারা ডানপন্থিদের সঙ্গে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে গত এক বছর ধরে এর প্রত্যকটিকেই অবমাননা করেছেন। এসবকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। নারীর উপর হামলা করছেন যত্রতত্রভাবে মব দিয়ে। এসব আগে শুধু জামাত-হেফাজতরা করতো। আর আপনারা এখন হয়েছেন জামায়াত ইসলামের বি-টিম। কার্যত জামায়াত-হেফাজতীদের সঙ্গে আপনারা একাকার। সরকারের কর্মকাণ্ডে জামাতের সমর্থন দেখলে বুঝা যায়, এটিও এখন সরকারি পার্টি।

আমি-আমরা আতঙ্কিত। যদি কোনো মেকানিজমের মাধ্যমে (যেভাবে আওয়ামী লীগ ২০১৪ পরবর্তী ক্ষমতায় ছিলো) এনসিপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনের মাধ‍্যমে ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে এখানকার ভবিষ্যৎ কি? এই ধরনের ঘটনায় প্রথম শিকার হবে নারী ও মুসলিম ভিন্ন অন্যান্য ধর্মের লোকজন। যে নারীরা এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের পা থেকে প্রথম ধাক্কায় ফুটবল কেড়ে নেওয়া হবে। তাদের স্থান হবে অন্দরমহলে। ইতিমধ্যেই তাদের উপর মৌলবাদী আক্রমণ আমরা দেখেছি। অন্য ধর্মের লোকজনকে বাংলাদেশে থাকতে হবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। ইতিমধ্যে তারা ঐ নিম্নশ্রেণীতেই আছেন। তখন সেটি আইনে পরিণত হবে। এখানকার হাজার বছরে গড়ে উঠা সংস্কৃতি না-ই হয়ে যাবে। এই ধরনের আতঙ্ক আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো ইসলামফোবিয়া নয়। শরিয়া প্রতিষ্ঠা হওয়া দেশগুলোর ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। আমি-আমার দেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করবো না। আমি মধ্যপ্রাচ্যের শাসন ব্যবস্থাকে ঘৃণা করি। কারণ, সৌদি বা আরব আমিরাতের রেজিম আমরা দেখছি বহুবছর ধরে। সেখানে কি হচ্ছে আমরা জানি।

এখন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থাই এই দুনিয়াতে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কোনো স্বৈরশাসনই অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন চায় না। আপনারাও চান না। মনে রাখবেন, কোনো স্বৈরশাসকের রক্ষাকবচ হিসেবে জলপাই বাহিনী চূড়ান্ত ভূমিকা রাখতে পারেনি। আজকে গোপালগঞ্জে তারা আপনাদের রক্ষা করলেও চূড়ান্তভাবে আপনারা রেহাই পাবেন না। ২৪-এর ঘটনা তাই বলে।

১৬ জুলাই ২০২৫ । স্প্রিং ফিল্ড, মিসৌরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে

লেখক: গবেষক ও ডেইলি স্টারের সাবেক সাংবাদিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *