:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার অসীম জাওয়াদ মারা গেছেন। একই দুর্ঘটনায় আহত হন পাইলট সোহান। তিনি বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সকালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার সময় কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এ বিমানে ছিলেন উইং কমান্ডার সোহান হাসান খান ও স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ।
দুর্ঘটনার সময় তাঁরা জরুরি প্যারাসুট দিয়ে বিমান থেকে নদীতে অবতরণ করেন। এরপর বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী দল এবং স্থানীয় জেলেদের প্রচেষ্টায় দুজনকে উদ্ধার করা হয়। দুজনের মধ্যে আসিম জাওয়াদের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দ্রুত তাঁকে বিএনএস পতেঙ্গাতে নেওয়া হয়। চিকিৎসক সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি প্রাঙ্গণে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। জাওয়াদের জানাজায় অংশ নেন সেনা, বিমান, নৌবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়াও ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আরও অনেকে।
জাতীয় পতাকায় জড়ানো জাওয়াদের মরদেহের সামনে অশ্রুসিক্ত চোখে দোয়া চান বাবা ডা. মো. আমান উল্লাহ। জানাজা শেষে জাওয়াদের মরদেহ এখন গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার গোপালপুরে নেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়।
বিমানটিকে সরিয়ে নদীতে নিয়ে যান দুই বৈমানিক
প্রশিক্ষণ বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে দুই বৈমানিক অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিমানটিকে বিমানবন্দরের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যান। আজ বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমানবাহিনীর একটি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আজ সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে চট্টগ্রামের বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার সময় কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। দুর্ঘটনার পর বৈমানিক উইং কমান্ডার মো. সোহান হাসান খান ও স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ জরুরি প্যারাসুট দিয়ে বিমান থেকে নদীতে অবতরণ করেন। দুই বৈমানিককে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী দল এবং স্থানীয় জেলেদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উদ্ধার করা হয়। বৈমানিকদের মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য বিএনএস পতেঙ্গাতে নেওয়া হয়। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের হতাহতের ঘটনায় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নানের নির্দেশে দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আইএসপিআর জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। দুর্ঘটনায় পতিত বিমানটিকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
‘আমি ছেলেকে ছাড়া বাঁচব কী করে’
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের বৈমানিক নিহত আসিম জাওয়াদ রিফাতের (৩১) মানিকগঞ্জের বাড়িতে চলছে মাতম। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলা শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকার বাসায় গিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়।
নিহত আসিম জাওয়াদ সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের চিকিৎসক আমান উল্লাহর ছেলে। তাঁদের শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকায় একটি বহুতল ভবনে একটি ফ্ল্যাট আছে। মা নিলুফা আক্তার খানম ও বাবা আমান মানিকগঞ্জ শহরে ওই ফ্ল্যাটে থাকেন। বৈমানিক আসিম জাওয়াদের স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জ শহরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা নিলুফা আক্তার বাসার একটি কক্ষের মেঝেতে শুয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা সেবাযত্ন করছেন। এরই মাঝে বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলে কোথায়? আমার ছেলেকে এনে দাও। আমি ছেলেকে ছাড়া বাঁচব কী করে।’ এরপর তিনি আবার মূর্ছা যান। নিহত বৈমানিকের বাবা আমান উল্লাহকে বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে বিকেলে তিনি চট্টগ্রামে যান।
২০১৬ সালে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ অন্তরা খানমকে বিয়ে করেন। তাঁদের আয়েজা খানম নামের ছয় বছরের এক মেয়ে এবং এক বছরের এক ছেলে রয়েছে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন।
স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের খালাতো ভাই মো. মশিউর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই জাওয়াদের স্বপ্ন ছিল বৈমানিক হবেন। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তবে অকালে সবাইকে শোকে রেখে তিনি চলে গেলেন।
২০ মার্চ ১৯৯২ সালে আসিম জাওয়াদ জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে তিনি ঢাকার সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে বিএসসি (অ্যারো) পাস করেন। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে ক্যাডেটদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান সোর্ড অব অনার প্রাপ্তিসহ জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন।
চাকরিকালীন তিনি দেশ-বিদেশে পেশাগত বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে এভিয়েশন ইন্সট্রাক্টর্স পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া তিনি চীন থেকে ফাইটার পাইলটস ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স, ভারত থেকে অপারেশনাল ট্রেনিং ইন এভিয়েশন মেডিসিন ফর ফাইটার পাইলটস কোর্স, বেসিক এয়ার স্টাফ কোর্স ও কোয়ালিফায়েড ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর্স কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি পেশাদারি দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মফিজ ট্রফি’, ‘বিমানবাহিনী প্রধান ট্রফি’ ও বিমানবাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র লাভ করেন। এ ছাড়া ভারতীয় বিমানবাহিনীতে কোর্সে অংশগ্রহণ করে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ইন্ডিয়ান এয়ার অর্জন করেন।
জীবন দিয়ে ক্ষতি থেকে বাঁচালেন পাইলট জাওয়াদ
নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনমানুষকে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছেন চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানের দুই পাইলট। বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পাইলটদের এ বীরত্বের কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
আইএসপিআর জানিয়েছে, আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এর আগে যান্ত্রিক ত্রুটিতে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। সে সময় বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে বিমানবন্দরের পাশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বিমানটিকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যান দুই পাইলট। এর ফলে অনেক বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় স্থানীয় মানুষজন।
চট্টগ্রাম বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, আসিম ২০১০ সালে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স অ্যাকাডেমিতে (বাফা) যোগদান করেন। তিনি ২০১১ সালে একজন পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ওই সময় প্রশিক্ষণে সামগ্রিকভাবে সেরা পারফরম্যান্সের জন্যে তিনি পেয়েছেন গৌরবমণ্ডিত সোর্ড অব অনার।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি কর্ণফুলী নদীতে ছিটকে পড়ে পানিতে তলিয়ে যায়। এর আগে বিমান থেকে দুই পাইলট প্যারাশুটযোগে নেমে যান। পরবর্তীতে নদী থেকে দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আসিম জাওয়াদের।
১১ ঘণ্টা পর উদ্ধার সেই বিধ্বস্ত বিমান
ইঞ্জিনে আগুনের ঘটনায় কর্ণফুলী নদীতে আঁচড়ে পড়া বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার প্রায় ১১ ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বিমানটি উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সংস্থাটির উদ্ধারকারী জাহাজ বলবানর সহায়তায় বিমানটি উদ্ধার করা হয় বলে জানানো হয়েছে।
বেলা পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন বোটক্লাবের পাশে কর্ণফুলী নদীতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
দুর্ঘটনার পর নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থলে এসে বিমানটি উদ্ধারে কাজ শুরু করেন। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে এসে জাহাজটি উদ্ধারে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিশেষ টিম সোয়াডস। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে নৌবাহিনীর এই বিশেষ টিম। দিনভর চেষ্টা শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে সংস্থাটি বিমানটি উদ্ধারে সক্ষম হন।
চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা
২০১২ ও ২০১১ সালে পৃথক দুটি ঘটনায় দুজন পাইলট প্যারাসুট ব্যবহার করে নেমে রক্ষা পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে সংঘটিত আরেক দুর্ঘটনায় পাইলটের খোঁজ মেলেনি।
২০১৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিএএফ ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর সাগরে বিধ্বস্ত হয়। এরপর পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের কাছে একটি বিএএফ যুদ্ধবিমান কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত হয়। সেসময় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ সানজিদ প্যারাসুট ব্যবহার করে নেমে রক্ষা পান।
২০১১ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। ওই সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুনতাসিন বিমান থেকে বের হতে সক্ষম হন।