হাসিনার বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর মামলার সাক্ষী

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

গুম-নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে অভিযোগ দায়ের করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি। 

বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় উপস্থিত হয়ে তিনি হাসিনার বিচার চান। 

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, সুখরঞ্জন বালি চিফ প্রসিকিউটর অফিসে অভিযোগ দাখিল করতে এসেছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তাকে অপহরণ করে আটকে রাখা হয়, গুম ও নির্যাতন করা হয় এবং দীর্ঘদিন ভারতের কারাগারে তাকে আটক রাখা হয়।

এই সুখরঞ্জন বালি ছিলেন সাঈদীর মামলার রাষ্ট্রপক্ষের এক সাক্ষী। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে তিনি আদালতে সাঈদীর পক্ষে বক্তব্য দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আদালত চত্বর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। পরে, তাকে ভারতের একটি কারাগারে পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

অনেক দিন নিখোঁজ থাকার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর দীর্ঘ সময় পর তিনি প্রকাশ্যে এসে নিজের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ের করলেন।

সাঈদীর মামলার আলোচিত সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অপহরণ, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে অপহরণ, আটক রাখা এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল দাবি করেন তিনি।

এরপর সাংবাদিকদের বলেন তিনি বলেন, সাঈদী ভালো মানুষ ছিলেন। দুইবার এমপিও হয়েছিলেন। এমপি থাকাকালে আমরা মায়ের কোলে ঘুমিয়েছি। তাকে আমি ভাঙ্গা পুল পার করে আমার সেন্টারে নিয়ে এসেছিলোম। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, “এমপি হতে পারি আর না পারি এই রাস্তার পুল আমি করে দেব।” তিনি পরে সেটা করেছেন। সেজন্যে তার ওপর এতো মায়া ছিল আমার।

সুখরঞ্জন বালি আরও বলেন, তিনি সৎ ও ভালো মানুষ ছিলেন। এজন্য আমি তার জানাজায় গিয়েছি। ছয়-সাত লাখ মানুষ হয়েছিল সেখানে। কিন্তু আমি একা বক্তব্য দিয়েছি। এরপর আমি বাড়িতে থাকতে পারিনি ওই সময়ের সরকারের চাপে। আমি বাগানে থেকেছি।

সুখরঞ্জন বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্য প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয় তাকে। ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর সাক্ষ্য দিতে এলে সাদা পোশাকধারী পুলিশ মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। গুম করে রাখা হয় ২ মাস ১৭ দিন। পরে সীমান্ত পার করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ভারতে ৫ বছর জেলে ছিলেন তিনি।

প্রসিকিউশন অফিসে এ সংক্রান্ত পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান সুখরঞ্জন বালির আইনজীবী পারভেজ হোসেন। তিনি বলেন, এ অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, সাবেক প্রসিকিউটর হায়দার আলীসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধে জাড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও পরে আপিলে সেই রায় পরিবর্তন হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে এই মামলাকে কেন্দ্র করে সাক্ষী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

অভিযোগে সুখরঞ্জন বালি উল্লেখ করেন, ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা চলাকালে তাকে পিরোজপুর থেকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আনা হয়। সেসময় তাকে জোরপূর্বক সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চাপ দেওয়া হয় এবং শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।

সুখরঞ্জন বালি বলেন, আমার ভাই বিশাবালীকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এ বিষয়ে আমি তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে প্রকৃত ঘটনা বলি। কিন্তু তিনি আমাকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নামও উল্লেখ করতে বলেন। আমি রাজি না হলে তিনি আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। পরে অন্য কর্মকর্তারাও আমাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে চাপ ও হুমকি দেন। আমি তাদের হাত থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যাই।

সুখরঞ্জন বালি জানান, পরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা ট্রাইব্যুনালে জানানোর জন্য তাকে অনুরোধ করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি নেন।

কিন্তু ৫ নভেম্বর ২০১২ সকালে ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণ থেকে তাকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা জোরপূর্বক একটি গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তিন মাস আটকে রাখার পর তাকে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে গিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

সুখরঞ্জন বালির অভিযোগ, তাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট এলাকায় নিয়ে আটক রাখা হয় এবং টানা পাঁচ বছর কারাভোগ করতে হয়। এরপর তিনি মুক্তি পান।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই আমাকে অপহরণ, আটক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এ ঘটনায় আমি আইনি প্রতিকার চাই।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় তৎকালীন অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মাওলানা সাঈদী আবেদন করলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেয়। তাতে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ আসে। তারপর থেকে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। বন্দি অবস্থায় ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।

সুখরঞ্জন বালী বলেন, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাকে অপহরণ, গুম এবং ৫ বছর অবৈধভাবে কারাবন্দি রাখাসহ আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়ের আমি বিচার চাই।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *