■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। নেপালের প্রেসিডেন্টের দপ্তর শুক্রবার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করে। রাতেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি।
নেপালি সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, নতুন এই সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে।
সুশীলা কারকি নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। তার সরকারের মন্ত্রিসভার আকার ছোট হবে এবং আজ রাতেই প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন তিনি। এ বৈঠক থেকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব দেবেন তিনি।
৭৩ বছর বয়সী সুশীলা কারকি নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এই পদে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতার’ জন্য আলোচিত ছিলেন তিনি।
সুশীলা কারকি ২০১৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নেপালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হন। বিচারক থাকাকালীন তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এ কারণে জেন-জির কাছে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
বিরাটনগরে ৭ জুন ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করা সুশীলা সুশীলা কারকি নেপালের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধান বিচারপতি। ১১ জুলাই ২০১৬ সালে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবিক বিজ্ঞানে স্নাতক ও পরে ভারতীয় বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে আইন বিষয়ে স্নাতক হয়ে ১৯৭৮ সালে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন।
১৯৯০ সালের পঞ্চায়েত শাসনবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি বিরাটনগর জেলে বন্দি হন। বন্দিত্বের অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে ‘কারা’ শীর্ষক একটি উপন্যাস রচনা করেন।
সুশীলা কারকি ২০০৮ সালে নেপাল বার অ্যাসোসিয়েশনে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হন এবং ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাড-হক জাস্টিস হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১০ সালে তার পদ স্থায়ী করা হয়। প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি দুর্নীতিবিরোধী কঠোর মনোভাবের জন্য পরিচিত হন।
২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অপসারণ প্রস্তাব আনা হয়, যা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হিসেবে ধরা হয়। তবে জনসাধারণের চাপে এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশনার কারণে প্রক্রিয়াটি স্থগিত করা হয়। এরপর ৬ জুন ২০১৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
অবসর গ্রহণের পর তিনি সমাজকর্ম ও সিভিক আন্দোলনে সক্রিয় হন। গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার পাশাপাশি দুর্নীতি বিরোধী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন। সাবেক মন্ত্রী জয়প্রকাশ গুপ্তাকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা তার উল্লেখযোগ্য অর্জন।
তিনি নেপালি, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় দক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান, চীন, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া ও নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন।
একবার ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুশীলা বলেছিলেন, ভারত নেপালকে অনেক সহায়তা করেছে।
তরুণদের বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। সরকার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলেন তরুণেরা। তাঁরা দেশে জেঁকে বসা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রথম দিনের সংঘর্ষে ২০ জন নিহত হওয়ার পরদিন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তবে এর পরও দেশটিতে সহিংসতা চলতে থাকে। ২০০৮ সালে গৃহযুদ্ধ ও রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালে এই কয়েক দিনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটে, যাতে অন্তত ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরদিন নেপালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর তৎপরতায় দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের চেষ্টা চলে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁদের কয়েক দফা বৈঠকের পর নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কারকির বিষয়ে মতৈক্য হয়।
বিক্ষোভকারীদের একজন প্রতিনিধি বলেছেন, সুশীলা ক্ষমতা গ্রহণ করে বর্তমান পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করবেন। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন তিনি।
এর আগে একজন সংবিধানবিশেষজ্ঞ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘জেন জি-রা তাঁকে (সুশীলা) চায়। এটা আজই ঘটবে।’ বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগেরই বয়স জেন-জি প্রজন্মের হওয়ায় নামটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তাদের জেনারেশন জেড বা জেন-জি বলা হয়।
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পরও পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী ও নেতাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে নেন। এর মধ্যে কারাগারেও বিদ্রোহ শুরু হয়। কারাগার থেকে পালিয়ে যান বহু বন্দী। কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, এই কয়েক দিনে নেপালের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ জন কয়েদি পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে কিছু কয়েদিকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখনো ১২ হাজার ৫৩৩ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সহিংসতায় অন্তত ৫১ জন নিহতের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে নেপাল পুলিশের মুখপাত্র বিনোদ ঘিমিরে গতকাল জানিয়েছেন। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, নিহতদের মধ্যে বিক্ষোভকারী ২১ জন, কয়েদি ৯ জন, পুলিশের সদস্য ৩ জন এবং অন্যান্য ১৮ জন। অন্যান্য বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। বিক্ষোভে অন্তত ১ হাজার ৩০০ জন আহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বুধবার থেকে নিরাপত্তা রক্ষার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করে সেনাবাহিনী। পুলিশের সঙ্গে মিলে তারা বেহাত হয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করছে। গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২৬৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দ্য হিমালয়ান টাইমস–এর প্রতিবেদনে।
আজ কাঠমান্ডুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিছু কিছু দোকান খুলেছে, রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। পুলিশ সদস্যদের হাতে এখন আগের মতো বন্দুক নেই। তাঁরা লাঠি হাতে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কিছু রাস্তা এখনো বন্ধ আছে।সেনাসদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা আগের চেয়ে কম।