■ নীলফামারী প্রতিনিধি ■
উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) সকাল ৯টায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার থেকে ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
এর আগে বুধবার (১৩ আগস্ট) সকালে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রথমে ৭ সেন্টিমিটার ওপরে পৌঁছায়, পরে কিছুটা কমে ৪ সেন্টিমিটারে নেমে আসে। রাতের বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে ভোরের দিকে আবারও তা বেড়ে ১১ সেন্টিমিটার ওপরে উঠে যায়।
টানা ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিপৎসীমার ওপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় লালমনিরহাট ও নীলফামারীর বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে অন্তত ৪৫টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রোপা আমনসহ নানা ফসলের ক্ষেত।
তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী, খালিশা চাপানী ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের অন্তত ১৫টি গ্রাম ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
প্লাবিত হয়েছে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল। এর মধ্যে গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, কালমাটি, বাহাদুরপাড়া, পলাশী এবং সদর উপজেলার ফলিমারী, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী ও গোকুন্ডা ইউনিয়নে পানি ঢুকেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, জুলাইয়ের শেষ দিকে ও আগস্টের শুরুতে দুই দফা পানি বৃদ্ধির পর এবার তৃতীয় দফায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তারা বারবার ত্রাণের বদলে স্থায়ী সমাধান হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
আদিতমারীর গোবর্ধন গ্রামের মতিয়ার রহমান বলেন, বন্যার পানিতে সাত দিন ধরে রান্না করতে পারিনি। গরু-ছাগল ও পরিবারের সদস্যদের উঁচু জায়গায় রেখেছি। সাহায্যের চেয়ে চাই পানি যেন আর না আসে।
পানিবন্দি মর্জিনা বেগম বলেন, গরু-ছাগলের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। ১০ কেজি চাল পেয়েছি, কিন্তু এটা সমাধান নয়। বারবার যেন বন্যা না হয়, সেই ব্যবস্থা চাই।
খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল আলীম বলেন, বারবার বন্যায় ধান, পাট, মাছ সব নষ্ট হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া মুক্তি নেই।
ডিমলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে থাকে। এতে ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেরস্বর ও পূর্ব ছাতনাই গ্রামের বোল্ডারের চর, খোকার চর, খাড়াপাড়া, ফ্লাটপাড়াসহ তিস্তাপারের বিভিন্ন চরের লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মানুষ আতঙ্কে আছেন।
টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে নদীর কয়েকটি চ্যানেল বের হয়ে পূর্বখড়িবাড়ী মৌজায় বেশ কিছু আবাদি জমি তলিয়ে গেছে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে আমরা চ্যানেলগুলো বন্ধে কাজ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব কাজে আমাদের সহযোগিতা করছে। চরাঞ্চলের দুই শতাধিক পরিবারের বাড়িঘরে পানি উঠেছে।
পাউবো জানিয়েছে, আগামী দুই দিন এই অঞ্চলে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকতে পারে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে এটি তিস্তায় তৃতীয় দফা বন্যা। জুলাইয়ের ২৯ তারিখে প্রথম দফায় এবং ৩ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। এবার ১৩ আগস্ট থেকে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে এবং এখনও বিপদের আশঙ্কা কাটেনি।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মিটারী ইউপি সদস্য রমজান আলী বলেন, সকাল থেকে তিস্তায় হু হু করে বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্মিটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, সকাল থেকে পানি বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবারের বন্যা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চলের পরিবারগুলোকে সতর্কতা অবলম্বনসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী দু’দিন এই অঞ্চলে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকতে পারে। এতে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে স্বল্পমেয়াদী বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরের সুরক্ষা বাঁধের বড় অংশ ধসে পড়েছে। এতে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। কয়েক দিন ধরে পানির প্রবল স্রোত আর ক্ষিপ্ত শব্দে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে লালমনিরহাট–রংপুর সড়কসহ আশপাশের এক হাজারের বেশি পরিবারের জন্য।
বুধবার (১৩ আগস্ট) দেখা যায়, উজান থেকে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি তিস্তার পানিপ্রবাহ দ্রুত বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র স্রোতের ধাক্কায় প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ পশ্চিম তীরের বাঁধের মাটি ধুয়ে যাচ্ছে, ব্লকগুলো একের পর এক নেমে যাচ্ছে পানির তলায়।
স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গিয়ে সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রায় ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করে, যা রংপুর–লালমনিরহাটের যোগাযোগ সহজ করেছে। কিন্তু বর্তমান ভাঙন নিয়ন্ত্রণে না এলে সেতু ও সংলগ্ন সড়ক বড় বিপদের মুখে পড়বে।
গঙ্গাচড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, ‘বন্যায় তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেবসহ আশপাশের এলাকায় গত কয়েক দিনে নদীভাঙনে শতাধিক বাড়ি বিলীন হয়েছে। শুধু শিবদেব গ্রামেই সাম্প্রতিক ভাঙনে অন্তত ৫০টি বাড়ি, একটি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হারিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, তীব্র স্রোত ও অব্যাহত ভাঙনের কারণে অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে, কেউ কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, সাময়িক সহায়তার পাশাপাশি স্থায়ী ভাঙনরোধ ব্যবস্থা জরুরি, নইলে প্রতিবছর একই দুর্যোগের মুখে পড়তে হবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বুধবার ও বৃহস্পতিবার রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। একই সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার নদনদী সতর্ক সীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে, আর পদ্মা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার পঞ্চগড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। উজানে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গেও ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবারও রংপুর বিভাগ ও তিস্তার উজানে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে।’