:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
৫০ বছরের মধ্যে ইসরায়েলে প্রথম ইরানি হামলা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। শনিবার রাতে এবং রোববার সকালে ইসরায়েলকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করে শত শত ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে ইরান।
এর বেশিরভাগই প্রতিহত করেছে বলে দাবি করছে ইসরায়েল। তবে অন্তত একটি গোয়েন্দা কেন্দ্র এবং একটি সেনাঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও সামরিক নজির স্থাপন করেছে ইরান।
এটি ছিল কোনো দেশের দ্বারা পরিচালিত একক বৃহত্তম ড্রোন হামলা। আর প্রায় অর্ধ শতকের শত্রুতার ইতিহাসে ইরান এই প্রথম সরাসরি ইসরায়েলে আক্রমণ করল।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এই সামরিক অপারেশনটিকে ‘ট্রু প্রমিজ’ বা ‘সত্য প্রতিশ্রুতি’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তেহরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ শীর্ষ নেতারা ইসরায়েল এবং অন্যদের আক্রমণের পাল্টা প্রতিশোধ ও শাস্তির প্রতিশ্রুতির কথাই বলে আসছেন এতোদিন ধরে।
এই হামলাটি ছিল গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার সরাসরি প্রতিশোধ। ওই হামলায় সিরিয়া ও লেবাননে নেতৃত্বদানকারী অপারেশনের দায়িত্বে থাকা দুই জেনারেল এবং আরও ছয়জন লোকসহ সাতজন আইআরজিসি সদস্য নিহত হন।
এই অভিযান ছিল মূলত ইরানের প্রতিরোধ সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বমূলক নীতি এবং এই অঞ্চলজুড়ে সামরিক হামলা, বিশেষ করে ইরাকে শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হত্যার পর ইরান আপসের নীতি অবলম্বন করেছিল বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকেরা।
গাজা যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলি বিমান হামলায় সিরিয়ার আরেক শীর্ষ আইআরজিসি কমান্ডার রাজি মুসাভিকে ডিসেম্বরের শেষের দিকে হত্যার পর ইরানি কর্মকর্তারা ‘কৌশলগত ধৈর্য’ দেখিয়েছেন বলেই মনে করা হয়।
নজিরবিহীন ইরানি হামলা হয়তো গাজা উপত্যকায় কয়েক হাজার নারী ও শিশুর মৃত্যু থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে নেবে। কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে মুসলিম বিশ্বে ইরানের সফট পাওয়ার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। যেখানে দেশটিকে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে।
ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য ঠিক কতটি ড্রোন বা ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে ইরানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, ৩০০ টিরও বেশি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
ইরানি ড্রোনগুলো গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুই বছরেরও বেশি আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলেন, রুশ সামরিক বাহিনী ইরানের ডিজাইন করা শাহেদ ড্রোন তাঁদের ভূখণ্ডে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন রোববার (১৪ এপ্রিল) জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলায় প্রায় ৫০ কেজি ওজনের অপেক্ষাকৃত ছোট ওয়ারহেড বহনকারী শাহেদ–১৩৬ কামিকাজ ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
আইআরজিসি–এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে বলা হয়েছে, শাহেদ–২৩৮, যেটিতে ১৩৬ মডেলের প্রোপেলারের পরিবর্তে একটি টার্বোজেট ব্যবহার করা হয়েছে— ইসরায়েল আক্রমণে ব্যবহার করা হয়েছে। ২৩৮ মডেলটি উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ গতির। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার। উচ্চগতি পেতে গিয়ে এই ড্রোন থেকে শত্রুর র্যাডার ফাঁকি দেওয়ার মতো কিছু কৌশল ব্যবহারের সক্ষমতা বাদ দেওয়া হয়েছে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইমাদ এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পাভেহ ইসরায়েলে হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের পালমাচিম বিমানঘাঁটিতে হামলার সিমুলেশনসহ বৃহৎ আকারের সামরিক মহড়ায় আইআরজিসি ইমাদ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ডেজফুল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও উৎক্ষেপণ করা হয়।
ইরানের কাছে ফাত্তাহ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এটি মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছাতে সক্ষম। একই প্রযুক্তির ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। তবে প্রথম দিকের হামলায় এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
তবে কয়েক ঘণ্টার বহুমাত্রিক হামলায় ইরান তার সর্বকালের সবচেয়ে বড় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পরিচালনা করতে পেরেছে। এই হামলাতেই ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সত্যিকার কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুর দিকে সর্বোচ্চ দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
আইআরজিসি কমান্ডার–ইন–চিফ হোসেন সালামি বলেন, অপারেশনটি সাফল্যের একটি স্তর অর্জন করেছে যা আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে! ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শুধু সামরিক অবস্থানগুলো লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নেগেভ মরুভূমিতে নেভাটিম বিমানঘাঁটি। সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলার জন্য এই ঘাঁটিই ব্যবহার করেছে ইসরায়েল।