■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ৭৯ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা এবং বাংলাদেশ সময় সোমবার রাত ১১টায় ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। এর আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শপথবাক্য পাঠ করান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার তিনি ট্রাম্পকে শপথ পড়ান।
দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় ট্রাম্প ‘সাধারণ জ্ঞানের বিপ্লব’-এর ডাক দেন।
ভাষণে ২০১৬ সালের প্রথম মেয়াদের মতোই ‘আমেরিকানদের কম প্রাণহানির’ প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, ‘ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পুনর্বিবেচনা করা হবে। বিচার বিভাগ এবং সরকারের নিষ্ঠুর, হিংসাত্মক এবং অন্যায্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অবসান ঘটবে।’
তিনি বলেন, ‘আমেরিকার স্বর্ণযুগের শুরু এখনই।’
ভাষণের শুরুতে ট্রাম্প উপস্থিত বেশ কয়েকজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘আজ থেকে, আমাদের দেশ সমৃদ্ধ হবে এবং সারা বিশ্বে আবার সম্মানিত হবে। আমরা প্রতিটি জাতির ঈর্ষার বিষয় হব এবং আমরা আর নিজেদের (দুর্বলতার) সুবিধা নিতে দেব না।’
অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘দেশজুড়ে পরিবর্তনের জোয়ার বইছে।’
ট্রাম্প বলেন, ‘সারা বিশ্ব সূর্যালোকে ভেসে যাচ্ছে (সম্ভাবনা অর্থে) এবং আমেরিকার কাছে এই সম্ভাবনা আগের মতো কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে।’
ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বাইডেন প্রশাসন এবং অভিবাসী সংকট মোকাবিলার কৌশল নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন।
তিনি বলেন, দেশের (নেতিবাচক) চ্যালেঞ্জগুলোর বিনাশ ঘটবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘উগ্রপন্থী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার’ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
তিনি বলেন, পূর্ববর্তী প্রশাসন ‘বিপজ্জনক অপরাধীদের’ আশ্রয় এবং সুরক্ষা দিয়েছে, যারা অবৈধভাবে আমাদের দেশে ঢুকেছে। সরকার ‘বিদেশি সীমান্ত রক্ষার জন্য সীমাহীন তহবিল’ দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার সীমান্ত রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের এখন এমন একটি সরকার আছে, যারা ঘরের একটি সাধারণ সংকটও মোকাবিলা করতে পারে না।’ সম্প্রতি নর্থ ক্যারোলাইনার ঘূর্ণিঝড় এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন।
অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প দাবি করেছেন, পানামা খাল পরিচালনা করে চীন।
ট্রাম্প পানামা খাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন, ‘ (পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া) একটি নির্বোধ উপহার যা কখনই দেওয়া উচিত হয়নি।’
তিনি দাবি করেন, ‘চীন পানামা খাল পরিচালনা করছে।’
ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এটি (পানামা খাল) চীনের কাছে দিইনি। আমরা এটি পুনরুদ্ধার করতে যাচ্ছি।’ এরপরই সমর্থকেরা তুমুল করতালি দিয়ে তাঁকে সমর্থন জানান। এ সময় জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস দর্শকসারিতে নির্বিকার বসে থাকতে দেখা যায়।
একই গাড়িতে চড়ে হোয়াইট হাউস থেকে মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে পৌঁছান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন।
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া, ছোট ছেলে ব্যারন, টিফানি, লারা, এরিক, জ্যারেড কুশনার, ইভাঙ্কা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথি হিসেবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্পেসএক্স ও টেসলার সিইও ইলন মাস্ক, গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই, মেটার সিইও মার্ক জুকারবার্গ, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
কমপক্ষে দুই লাখ অতিথি অভিষেকে আমন্ত্রিত হয়েছেন।
যারা ভেতরে ঢোকার টিকিট পাননি, তারা ন্যাশনাল মলে বড় স্ক্রিনে অনুষ্ঠান সরাসরি উপভোগ করেছেন। শপথের পর ট্রাম্প ক্যাপিটল থেকে হোয়াইট হাউজে একটি জমকালো প্যারেডের মাধ্যমে যাত্রা করেন। ট্রাম্পের সম্মানে ক্যাপিটল রোটুন্ডায় কুচকাওয়াজও আয়োজন করা হয়। এর আগে ১৯৮৫ সালে ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর ১২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট পরাজয়ের পর দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে ফিরলেন।
সাধারণত মার্কিন কংগ্রেস ক্যাপিটল হিলের সামনে উন্মুক্ত জায়গায় শপথ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে ওয়াশিংটনে মাইনাস ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইনডোরে অনুষ্ঠিত হয় শপথ অনুষ্ঠান। শপথের পরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ট্রাম্প।
১০০ নির্বাহী আদেশে সইয়ের ঘোষণা
ট্রাম্প গতকাল রোববার জানিয়েছেন, শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি প্রায় ১০০ নির্বাহী আদেশে সই করবেন। এসব আদেশের মাধ্যমে তিনি জো বাইডেন প্রশাসনের নেওয়া অনেক নীতি বাতিল করবেন এবং নিজের প্রথম মেয়াদের বিভিন্ন নীতি পুনর্বহাল করবেন।
ট্রাম্পের নীতিবিষয়ক নতুন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার রিপাবলিকান পার্টির জ্যেষ্ঠ কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে এই নির্বাহী আদেশগুলোর বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সূত্র জানায়, আলোচনায় নির্বাহী আদেশগুলোর সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন করা হলেও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
প্রথম দিনের যত উদ্যোগ
স্টিফেন মিলার জানান, ট্রাম্পের প্রথম দিনের নির্বাহী আদেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিফলন থাকবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অভিবাসনসংক্রান্ত কঠোর পদক্ষেপ, সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং মাদক চোরাচালান-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা।
ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদের সময় চালু করা ‘অভিবাসী সুরক্ষা প্রটোকল নীতি’ পুনরায় কার্যকর করবেন। এই নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থীদের মেক্সিকোতেই অপেক্ষা করতে হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন
• নভেম্বর ৬ : প্রেসিডেন্ট পদের বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলীয় আইনপ্রণেতারা দেশটির সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটেরও নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। ফ্লোরিডায় বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠা সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, ‘‘আমাদের এক নজিরবিহীন ও শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে আমেরিকা।’’
• নভেম্বর ৭ : জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন জো বাইডেন। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
• নভেম্বর ৮ : ট্রাম্প নিজ মন্ত্রিসভার বাছাই শুরু করেন। প্রথমেই মার্কিন সীমান্ত জার হিসাবে সাবেক ভারপ্রাপ্ত আইসিই পরিচালক টম হোমনকে মনোনয়ন দেন তিনি।
• নভেম্বর ১২ : সরকারি নব-সৃষ্ট দক্ষতা বিভাগের সহ-প্রধান হিসাবে বিলিয়নেয়ার ইলন মাস্কের নাম ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
• নভেম্বর ১৩ : সিনেটর মার্কো রুবিওকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিনিধি ম্যাট গেটজকে অ্যাটর্নি জেনারেল মনোনীত করেন ট্রাম্প। রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ জিতেছে।
হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন ট্রাম্প ও বাইডেন।
• নভেম্বর ১৪ : মার-এ-লাগোতে অনুষ্ঠিত গালা নাইটে নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম বক্তৃতা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গালা নাইটের অনুষ্ঠানে দেশটির অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালোন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তিনি ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাইয়ের প্রশংসা করেন।
• নির্বাচনের দিন থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে
• নভেম্বর ২০ : বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের রকেট উৎক্ষেপণ দেখতে টেক্সাসে যান ট্রাম্প।
• নভেম্বর ২১ : অতীত আচরণের অভিযোগে সিনেটে রিপাবলিকানদের বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন গেটজ। তার স্থলাভিষিক্ত হিসাবে পাম বন্ডিকে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প।
• নভেম্বর ২২ : দেশটির অর্থমন্ত্রী হিসাবে বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী স্কট বেসেন্টকে মনোনয়ন দেন ট্রাম্প।
• নভেম্বর ২৩ : ট্রাম্প বলেন, তিনি মেক্সিকো এবং কানাডা থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। একই সঙ্গে চীনা আমদানির ওপর ‘‘অতিরিক্ত ১০ শতাংশ’’ শুল্ক চাপিয়ে দেবেন তিনি।
• জানুয়ারি ৬ : কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট গণনায় সভাপতিত্ব করেন কমলা হ্যারিস। নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন বলে ঘোষণা দেন তিনি।
• জানুয়ারি ১০ : মার্কিন এক পর্ন তারকাকে ঘুষের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ট্রাম্পকে নিঃশর্ত মুক্তির স্থগিত সাজা দেওয়া হয়।
• জানুয়ারি ২০ : ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ওয়াশিংটনে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে শপথগ্রহণ করেন।