■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে তেল কেনার শাস্তি হিসেবে ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ ৫০ শতাংশে দাঁড়াল। যা চীনের চেয়ে ২০ শতাংশ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি।
বুধবার স্থানীয় সময় রাতে ট্রাম্প এই নির্বাহী আদেশ জারি করে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, ভারত সরকার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রুশ ফেডারেশন থেকে তেল আমদানি করছে… আমার বিচার অনুযায়ী, ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ‘‘অ্যাড ভ্যালোরেম ডিউটি’’ আরোপ করা প্রয়োজন।’
অ্যাড ভ্যালোরেম ডিউটি বা শুল্ক বলতে এমন এক ধরনের আমদানি শুল্ক বা কর বোঝায়, যা আমদানি করা পণ্যের মোট মূল্যের ওপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়। এটি সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
এই নির্বাহী আদেশ জারির কয়েক ঘণ্টা আগে একটি আমেরিকান টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারত ভালো বাণিজ্যিক অংশীদার নয়…তারা আমাদের সঙ্গে প্রচুর ব্যবসা করে…তাই আমরা ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলাম…কিন্তু আমি মনে করি, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি এটি বাড়িয়ে দেব; কারণ, তারা রাশিয়ার তেল কিনছে।’
ভারতের সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছিল, এই শুল্কের প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির ওপর ‘নগণ্য’ হবে।
এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় এলো, যখন ভারতের সরকারি একটি সূত্র জানিয়েছে—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চলতি মাসের শেষ দিকে সাত বছরেরও বেশি সময় পর চীন সফরে যাচ্ছেন।
গত কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা কোনো সমঝোতায় পৌঁছায়নি।
হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানায়, ‘‘ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য চলমান হুমকি। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।’’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘‘ভারতের রুশ তেল আমদানি যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপকে দুর্বল করে দিচ্ছে।’’
হোয়াইট হাউসের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারত শুধু রুশ তেল আমদানি করছে না, সেটি পরবর্তীতে বাজারে পুনরায় বিক্রিও করছে। এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থায়ন পাচ্ছে।
ট্রাম্পের প্রশাসন জানায়, এই শুল্কমূল্য আরোপের মাধ্যমে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশকে রাশিয়ার অর্থনীতিকে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখতে চায়। কোন কোন দেশ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে, তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে প্রেসিডেন্টকে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হবে বলেও জানানো হয়।
নতুন এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত এসেছে ট্রাম্পের কূটনৈতিক দূত স্টিভ উইটকফের মস্কো সফরের পর। ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খোঁজা।
এদিকে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিকে ‘‘অযৌক্তিক ও অন্যায্য’’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে নয়াদিল্লি। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধির জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে যুক্তরাষ্ট্রই ভারতকে রুশ গ্যাস আমদানির পরামর্শ দিয়েছিল।’’
তিনি জানান, যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপের দেশগুলো ঐতিহ্যগত জ্বালানি সরবরাহ নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ায় ভারতকে বিকল্প উৎস হিসেবে রাশিয়ার দিকে যেতে হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও সমালোচনা করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন এখনো রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করছে, তখন ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দ্বিমুখী নীতি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও গত বছর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে আনুমানিক ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করেছে।
বিবৃতিতে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘‘যেকোনো বৃহৎ অর্থনীতির মতো ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’’
‘‘এসব বিষয় নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়েছি, আমাদের আমদানি বাজারভিত্তিক এবং ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বৃহত্তর উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়। এই অবস্থায় ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক; বিশেষ করে যখন অন্যান্য অনেক দেশও তাদের জাতীয় স্বার্থে একই রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে।’’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘আমরা আবারও বলছি, এসব পদক্ষেপ অন্যায়, অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।’’
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের আরোপিত নতুন এই শুল্ক আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর হবে। ভারতীয় পণ্যের ওপর বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত এই শুল্ক যোগ হবে।
তবে মার্কিন স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের মতো নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক শুল্কের আওতাভুক্ত ভারতীয় পণ্যের জন্য বিদ্যমান ছাড় বজায় থাকবে। এছাড়া ওষুধের মতো সংবেদনশীল যেসব খাতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, সেসব খাতের পণ্য আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছাড় পাবে।
চলতি বছর ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করার পর শতাধিক দেশের ওপর বর্ধিত রপ্তানি শুল্ক চাপিয়েছেন ট্রাম্প। যেসব দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, আজ থেকে সেসবের শীর্ষে যৌথভাবে অবস্থান করছে ভারত ও ব্রাজিল। কারণ এই দু’টি দেশের ওপরেই ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
ভারত এবং ব্রাজিল ব্যতীত আরও যেসব দেশের ওপর চড়া শুল্ক চাপিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, সেগুলো হলো— সুইজারল্যান্ড (৩৯ শতাংশ), কানাডা (৩৫ শতাংশ), ইরাক (৩৫ শতাংশ) এবং চীন (৩০ শতাংশ)।
অর্থাৎ বর্ধিত শুল্কের হিসেবে এই মুহূর্তে ভারত ও ব্রাজিলের আশে পাশে আছে সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ইরাক ও চীন— এই চার দেশ।
ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ভারতের ওপর ১৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক ছিল, ব্রাজিলের ওপর ছিল ১০ শতাংশ।