■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২০ জন শিক্ষার্থীর জীবন বাঁচানো শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর দাফন সম্পন হয়েছে। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচিয়ে শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী প্রশংসিত হলেও তার মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তার দুই সন্তান। মায়ের দাফনের পর তার দুই ছেলেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) শিক্ষিকা ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী। তিনি ছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামের মৃত মুহিত চৌধুরীর মেয়ে। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে আয়য়ান রশিদ (১৫) দশম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে আদিল রশিদ (১০) ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
মাহেরীন চৌধুরী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। তার বাবা মহিতুর রহমান জিয়াউর রহমানের খালাতো ভাই। দাদি রওশানারা চৌধুরী ছিলেন জিয়াউর রহমানের খালা। বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ও মা সাবেরা চৌধুরী দুজনই সমাজসেবায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল স্ত্রীকে হারিয়ে শোকাহত। তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান এতিম হয়ে গেল। ছোট ছেলেটা গতকাল থেকে কোনো কথাই বলছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওদের জন্য দোয়া করবেন।
মাহেরীনের স্বামী সাংবাদিকদের বলেন, শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ও আমার হাত ধরে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
ভাঙা কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তান, ওদের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। আমি তাদের একা রেখে আসতে পারিনি।
মনসুর হেলাল বলেন, আগুন লাগার পর সবাই যখন দৌড়াচ্ছে, তখন মাহেরীন বাচ্চাদের বের করে আনছিল। কয়েকজনকে বের করে আবার ফিরে গিয়েছিল বাকি বাচ্চাদের জন্য। সেই ফেরাটা আর শেষ হয়নি।
মাহেরীনের চাচা রিকো চৌধুরী বলেন, ছোটবেলা থেকেই মাহেরীন মেধাবী ছিলেন। ঢাকায় থেকেও এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সহযোগিতা করতেন।
বগুলাগাড়ি এলাকার বাসিন্দা সোনালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মোস্তফা আজাদ বলেন, তিনি একজন সৎ, ভালো মানুষ ছিলেন। বই-খাতা কিনে দিতেন এলাকার শিশুদের। আমরা একজন আদর্শ মানুষকে হারালাম।
বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান বলেন, তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন মানবিক বীর। আমরা শিক্ষক সমাজ তার আত্মত্যাগে গর্বিত ও শোকাহত।
বিমান বিধ্বস্তের পর চারদিকে যখন হইচই, আতঙ্ক আর কান্না। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। আগুন আর ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে পুরো স্কুল চত্বর। তখনও থেমে যাননি তিনি। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়েছেন শিশুদের জন্য। নিজের শরীর জ্বলছিল- তবুও দৌড়ে বেড়িয়েছেন এক একটি শিশুর হাত ধরে ভবনের বাইরে বের করে আনতে। তিনি শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। বয়স মাত্র ৪২ বছর।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রাইমারি শাখার একটি ভবনের ওপরে বিকট শব্দে আছড়ে পড়ে প্রশিক্ষণ বিমানটি। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ভবনে। ওই সময় ভবনের ভেতরে ক্লাস চলছিল। ছিল অনেক শিশু শিক্ষার্থী। ভয়ে সবাই গুটিয়ে যায়। হঠাৎ করেই এগিয়ে আসেন মাহেরীন ম্যাডাম। তিনি তখন ভবনের নিচে শিশুদের হাত ধরে বের করে নিয়ে আসছিলেন। সব কিছু ছাপিয়ে তিনি দৌড়ে ঢুকে পড়েন ভবনের ভেতর। চোখ-মুখ ঢেকে, পোড়া ধোঁয়ার ভেতরেও খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে থাকেন শিশুদের।
শিক্ষার্থীদের অনেকে কাঁদছিল, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছিল হতবিহ্বল হয়ে। তখন মাহেরীন এক এক করে তাদের হাত ধরে বের করে আনেন। চোখের সামনে ভবনের ছাদ ধসে পড়ছে, আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে, তবু পিছু হটেননি তিনি।
সেনাবাহিনীর উদ্ধার টিম জানায়, ‘শুধু তার জন্যই অন্তত ২০ জন শিশু বেঁচে গেছে। না হলে এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হত’।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, ‘দেহের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছিল। তিনি শেষ মুহূর্তে বারবার বলছিলেন- বাচ্চাগুলো কেমন আছে?’