জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চবির দুই শিক্ষার্থী

■ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসী সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম। অবস্থার উন্নতি হয়নি। রাম দায়ের কোপে মাথায় মারাত্মক জখমের পর আছেন বেসরকারি হাসপাতালের লাইফ সাপোর্টে। লাইফ সাপোর্টে থাকার সময় পঞ্চম দিন পার হয়েছে। কিন্তু তার জ্ঞান না ফেরায় বেঁচে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্বজনরা। 

সায়েমের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনকই বলা যায়। তাঁর জ্ঞানের লেভেল ৩-এ চলে গিয়েছিল। পরে ৩ থেকে ৫-৬, এরপর গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৮-৯-এ ছিল। জ্ঞানের লেভেল সাধারণত আমাদের ১৫ থাকে। সিটি স্ক্যানে তাঁর হালকা হালকা রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। গতকাল মেডিকেল বোর্ড বসেছিল। এখন আবার অপারেশন করতে হতে পারে, নয়তো নরমাল চিকিৎসা যেভাবে চলছে, এভাবে চালিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।

নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন সায়েম। সেখানে চিকিৎসাধীন আরেক শিক্ষার্থী মামুন মিয়াকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি এখন আছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রামদার কোপে তার মাথায় হয়েছে গুরুতর ক্ষত। এটি এতটা গভীরে গেছে যে, খুলে ফেলতে হয়েছে খুলির একাংশ। খুলির ভাঙা অংশ ফ্রিজে রেখে মাথা মোড়ানো হয়েছে সাদা ব‍্যান্ডেজে। কালো কালিতে সেখানে লেখা হয়েছে ‘হাড় নেই চাপ দেবেন না।’

চিকিৎসকরা জানান, অবস্থার আরও উন্নতি হলে খুলি স্থাপনের কাজ শুরু হবে।

পার্কভিউ হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম বলেন, সায়েমের কনশাস লেভেল বা চেতনার মান এখনো সন্তোষজনক নয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মাথায় বড় একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। খুলির ভেতরের অংশ ও রক্তনালী ছিড়ে গেছে। তার জ্ঞান না ফেরায় আমরা পর্যবেক্ষনে আছি। গুরুতর আহত অপর ছাত্র মামুন মিয়ার মাথার খুলি পৃথক করে রাখা হলেও তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তাকে বুধবারই কেবিনে দেওয়া হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ্য হলে মাথার খুলিটি প্রতিস্থাপন শুরু করা হবে। 

এদিকে সায়েমের জন্য উৎকণ্ঠার সাথে হাসপাতালে অবস্থান করছেন স্বজনরা। মা শাহনাজ আমির ও বাবা আমির হোসেন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সোমবার ভোরে তারা বগুড়া থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন। এরপর থেকে পাঁচদিন ধরে পার্কভিউর আইসিইউর সামনে দিন কাটছে তাদের। অপেক্ষায় আছেন ছেলের জ্ঞান ফেরার আশায়।   

ইমতিয়াজ সায়েমের মা শাহনাজ আমির বলেন, তার অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আমরা আশা করছি দ্রুত যেন সায়েম সুস্থ্য হয়ে যান। আল্লাহর কাছে দোয়া করছি ছেলে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। 

মামুনের বড় বড় ভাই টাঙ্গাইলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। নাম মাসুদ রানা। ভাইয়ের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি। বললেন, ‘মামুন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে। তাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে কি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? যে আশা নিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালাম সেটা এখন ধুলিস্মাৎ হওয়ার পথে। ডাক্তার বলেছেন, সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। সুস্থ হলেও মেনে চলতে হবে অনেক বিধিনিষেধ।’

সায়েমের বাবা মোহাম্মদ আমির হোসেন ছেলের খবর শুনে বগুড়া থেকে ছুটে এসেছেন চট্টগ্রামে। হাসপাতালের করিডোরে কাটছে রাত। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ছেলেকে অনেকবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, মারামারিতে যাস না। কিন্তু সে বলল, আহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিতে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর শুনি আমার ছেলেকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে সন্ত্রাসীরা। একজন মানুষ কীভাবে আরেকজনকে এভাবে কোপাতে পারে?’

পার্কভিউ হাসপাতালের স্পেশালাইজড ইউনিটের ইনচার্জ ডা. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘ইমতিয়াজ সায়েমের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুলির ভেতরের অংশ ও রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি। শুধু ব্লাড প্রেসারে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।’ 

মামুনের বিষয়ে তিনি জানান, তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খুলি ফ্রিজে রাখা হয়েছে। যদি সুস্থ থাকে, দুই থেকে আড়াই মাস পর তা পুনঃস্থাপন করা হবে। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দীর্ঘ সময় লাগবে।’

উল্লেখ্য, শনিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকার একটি ঘটনা থেকে সহিংসতার সূত্রপাত হয়। একজন ছাত্রী ভাড়া বাসায় দেরিতে ঢুকতে চাইলে দারোয়ান তার গায়ে হাত তোলেন। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন এবং তা গ্রামবাসীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ আহত হন প্রায় ৪০০ জন। এখনও তিন শিক্ষার্থী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।  

চবির সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, ৩১ আগস্ট সেদিন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে মামুনের অপারেশন করা হয়েছে। অপারেশনে মামুনের মাথা থেকে ১৩ টুকরো হাড় বের করা হয়েছে। তাঁর খুলি এখন ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। তাঁকে ধারালো দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার ফলে মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে।

ড. আনোয়ার হোসেন আরও জানান, মামুন সুস্থ হলে দুই মাস পর তাঁর খুলি লাগাতে হবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন। তাঁর অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। তিনি এখন কেবিনে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত শনিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকার একটি ঘটনা থেকে সহিংসতার সূত্রপাত হয়। একজন ছাত্রী ভাড়া বাসায় দেরিতে ঢুকতে চাইলে দারোয়ান তাঁর গায়ে হাত তোলেন। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন এবং তা গ্রামবাসীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ আহত হন প্রায় ৪০০ জন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *