■ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে চলা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে হামলা করেছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর।
সোমবার দুপুরে ঢাবির টিএসসি সংলগ্ন সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে এ হামলায় দুই শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা হলেন ঢাবির আরবি বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের খালেদ হাসান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের সানি সরকার।
মঙ্গলবার এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দায়ের করেছেন সানি সরকার।
এ সময় গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদেরও হেনস্তার শিকার হন।
হামলার ঘটনায় আগামীকাল বুধবার বেলা ১১টায় ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদী কর্মসূচি ডেকেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
তারা সানি সরকারের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম ঢাবি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধের দাবিতে মানববন্ধন করবেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমি আর মাহিন সাড়ে ১১টার দিকে টিএসসিতে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় খেয়াল করলাম, নটরডেম কলেজের পোশাক পরা চার শিক্ষার্থী কপালে ও হাতে কালো পতাকা নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাচ্ছেন। তখন আমি তাদের বুঝিয়ে বলার পর তারা সেগুলো খুলে ফেলেন। পরে আবার খেয়াল করলাম কালো পতাকা হাতে মাইকের কাছে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তারা কালো পতাকা উড়াচ্ছেন।’
কাদের আরও বলেন, ‘তখন আমরা তাদের যখন বোঝাতে গেছি যে আপনারা এই পতাকা নামিয়ে ফেলেন; এগুলো ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। তখন অভিযুক্তসহ (রায়ান) তিন থেকে চারজন চিল্লাচিল্লি শুরু করে এই বলে, আমরা নাকি ইসলামবিরোধী। আমাদের মারার জন্য উপস্থিত সবাইকে উসকে দেন তারা। পরে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা আমাকে টিএসসির ভেতরে নিয়ে যান। না হলে আমাকেও মারধর করা হতো।’
সূত্র জানায়, রায়ানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীর। ৫ আগস্টের পরে ঢাবি ক্যাম্পাসে হিজবুত তাহরীর যেসব কর্মসূচি পালন করেছে, সেগুলোয় সরব ছিলেন তিনি।
রায়ানের এক বন্ধু বলেন, ‘রায়ান দীর্ঘদিন ধরে হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত। ক্যাম্পাসে ওদের যত প্রোগ্রাম হয় সব জায়গায় রায়ান থাকে। মূলত সে এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করে।’ এ বিষয় বক্তব্য নিতে রায়ানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে, হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মামলা করবেন বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ঘটনা অবহিত করা হলেও তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে (সিরিয়াসলি) দেখছি। হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত থাকার যে অভিযোগ আসছে, আমরা সেগুলো আরও যাচাই-বাছাই করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখানে কাজ করছে। সবকিছু জেনে তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রক্টরিয়াল টিম নিষ্ক্রিয় ছিল—শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের জবাবে প্রক্টর বলেন, ‘সেখানে শত শত মানুষ ছিল। এখানে কোনো কিছু করতে গেলে ভেবেচিন্তে করতে হয়। তারা ভূমিকা রেখেছে। নিবৃত থাকেনি।’
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করবে না বলে জানান প্রক্টর। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা যদি মামলা করেন, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের যথাযথ সহযোগিতা করবে।
সানি সরকার লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, দুপুর একটার দিকে টিএসসিতে গিয়ে দেখেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রোগ্রাম করছে। সেখানে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পতাকা ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে তিনি বাধা দেন।
লিখিত অভিযোগে গতকালের পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সানি সরকার। তিনি লিখেছেন, ‘সকাল থেকেই ফিলিস্তিনের প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ততা ছিল। বিভিন্ন ভাইকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল—কীভাবে কী করা যায় আজকের প্রোগ্রাম নিয়ে। বেলা ১১টার পর থেকেই ভাইদের সঙ্গে বটতলায় বসা হয়, এরপর মলে (মল চত্বর) গিয়ে প্রোগ্রামের পরিকল্পনা শুরু করি। পরে টিএসসিতে গিয়ে বেলা একটার দিকে ফিলিস্তিনের পতাকা আনতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, সিটি কলেজ ও অন্যান্য কলেজের ছাত্ররা সম্ভবত ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রোগ্রাম করছে। সেখানে গিয়ে দেখি, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর পতাকা ব্যবহৃত হচ্ছে।’
সানি সরকার লিখেছেন, ‘আমি তাদের দু–একজনকে বুঝিয়ে বলি—ভাই, আপনারা একটি ভালো প্রোগ্রাম করছেন, এটিকে আমরা পরে চালিয়ে নেব। আমিও একজন মুসলমান, তবে অনুরোধ করব এই নিষিদ্ধ পতাকাটি নামিয়ে ফেলুন। রাজু ভাস্কর্যের সামনে যেকোনো আন্দোলন বা প্রোগ্রাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এসবের ছবি বা ভিডিও যদি আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই আপনারা এই পতাকাটি বাদ দিয়ে প্রোগ্রাম চালান।
‘আমার অনুরোধের পর দু–একজন পতাকা নামিয়ে পকেটে রেখে দেন। এরপর কাদের ভাই, খালেদ ভাই ও তানভীর ভাইয়েরাও বাকিদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছু (নিষিদ্ধ সংগঠন) হিযবুত তাহ্রীরপন্থী বিষয়টি বুঝতেই চায়নি। তারা আমাদেরকে “ইসলামবিদ্বেষী” আখ্যা দিয়ে মারতে আসে। আমি তখন বলি, ভাই, আপনারা একটি ভালো প্রোগ্রামে এসেছেন, এখন আমাদের ক্যাম্পাসে মারামারি করবেন? আমি তখন দু–একজনকে পেছনে পাঠিয়ে দিই, ফলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাচ্ছিল।’
এর মধ্যে জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী তাঁদের উসকে দেন উল্লেখ করে সানি সরকার লিখেছেন, ‘ফলে তারা আরেকবার মব তৈরি করে। এরপর প্রায় ৫০-৬০ জন মিলে আমার দিকে মারমুখী হয়ে আসে। অথচ আমি কেবল তাদের বোঝাতে চাচ্ছিলাম—আপনারা জানতেই পারছেন না যে আসলে কী করছেন। আমি তখন কোনোভাবে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। ভিড়ের মধ্যে আমাকে ইচ্ছেমতো মারধর করা হয়। অথচ যারা মারল, তারা আদৌ বুঝেছে কি কেন মারছে বা কাকে মারছে? আর আমাকে “ইসলামবিদ্বেষী” ট্যাগ লাগিয়ে দিল! আমি তাদের শুধু একটাই কথা বলব—আমার স্টোরির আর্কাইভগুলো দেখুন বা আমার ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে দেখুন, প্রমাণের অভাব হবে না।’
এ প্রসঙ্গে সানি সরকার আরও লিখেছেন, ‘কিন্তু আবেগপ্রবণ লোকদের কে বোঝাবে এসব কথা? সব ইসলাম মানেই নবীর প্রকৃত ইসলাম নয়। ইসলামের মধ্যেও কত ভণ্ড পীর ও বিভক্তি আছে, তা এদের কে বোঝাবে? (নিষিদ্ধ সংগঠন) হিযবুত তাহ্রীর আর তথাকথিত “তৌহিদি জনতা”—তাদের মধ্যে পার্থক্য কে বোঝাবে? দিন শেষে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে আজ নিজের দেশের ভাইয়ের হাতে মার খেতে হলো। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো বেঁচে থাকতাম কি না সন্দেহ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে এখনো বেঁচে আছি।’
ওই ঘটনার সূত্র ধরে তাঁর ওপর তিন দফায় আক্রমণ করা হয় উল্লেখ করে সানি সরকার লিখেছেন, ‘এমনকি রিকশায় তুলে দেওয়ার সময়ও আক্রমণ অব্যাহত ছিল। এ সময়কাল প্রায় ২০-২৫ মিনিট। তবু প্রশ্ন থেকে যায়—প্রক্টরিয়াল বডি এত সময়েও মব আটকাতে আসেনি কেন? এমনকি পরে এসেও কোনো ধরনের বাধা দেয়নি কেন?’
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন কীভাবে প্রোগ্রাম করতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলে সানি সরকার লিখেছেন, ‘যেখানে বহিরাগতদের কোনো কর্মসূচি করার অধিকার নেই, সেখানে আমরা এতটাই অনিরাপদ হয়ে পড়েছি যে বাইরের কেউ এসে প্রোগ্রাম বা তাদের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়? এর বিরুদ্ধে বাধা দিলে আমাদেরকেই এ ধরনের হামলার শিকার হতে হয়? এ বিষয়ে কি প্রশাসনের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?’
এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে যারা ‘মব’ উসকে দিয়েছে, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সানি সরকার।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বিবৃতি
গতকালের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আজ একটি বিবৃতি দিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। গতকালের কর্মসূচিগুলোতে বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের পতাকা উড়তে দেখা গেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গতকাল নানা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করে। কিন্তু গতকালের কর্মসূচিগুলোতে বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের পতাকা উড়তে দেখা গেছে। এর আগেও ফিলিস্তিনের পক্ষে আয়োজিত কর্মসূচিতে এ ধরনের পতাকা উত্তোলন আন্দোলনের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।’
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ বলেছে, এ ধরনের পতাকা ব্যবহার না করার অনুরোধ জানালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সানি সরকারের ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলে (নিষিদ্ধ সংগঠন) হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিগত সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজনকে প্রত্যক্ষ করা গেছে, যাঁরা ‘নাস্তিক’ ট্যাগ দিয়ে বহিরাগত ‘মব’ দিয়ে সানির ওপর তিন দফায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট ধরে শারীরিক নির্যাতন চালান। তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছেন আরও একাধিক শিক্ষার্থী।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ঘটনার পরপরই প্রক্টরিয়াল টিমকে জানানো হলেও তারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয় এবং আহত শিক্ষার্থীকে উদ্ধারে কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি ও কার্যক্রম প্রতিহত করতে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী হামলায় উসকানি দিয়েছেন এবং অংশ নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ।