■ ক্রীড়া প্রতিবেদক ■
দুবাইয়ে টানা পাঁচ জয়ের ফলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম দল হিসেবে তিনটি শিরোপার রেকর্ড গড়ল ভারত। ২০০০ সালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। ২৫ বছর পর দুবাইয়ে আবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ৪ উইকেটে জিতে এবার পুরোনো বদলা নিল ভারত।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত প্রথম শিরোপা জিতেছিল ২০০০ সালে। সেবার ভারত-শ্রীলঙ্কা যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এই টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় শিরোপা ভারত জিতেছে ২০১৩ সালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। দীর্ঘ ১২ বছর পর ভারত তৃতীয়বারের মতো জিতল চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা। যা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে অস্ট্রেলিয়া।
২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে ইতিহাস গড়ল ভারত। ইতিহাসে এই প্রথমবার পরপর দুটি আইসিসি ট্রফি জিতল ভারত। ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল। আর এবার জিতল ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে ভারতের আজ লক্ষ্য ছিল ২৫২ রান। দুবাইয়ে দুই ওপেনার গিল ও রোহিত ১১২ বলে ১০৫ রানের জুটি গড়েছেন। উদ্বোধনী এই জুটি ভেঙেছে মূলত গ্লেন ফিলিপসের নৈপুণ্যে। ১৯তম ওভারের চতুর্থ বলে মিচেল স্যান্টনারকে শর্ট এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে তুলে মারতে যান গিল। সুপারম্যানের মতো ডান দিকে উড়ে ছো মেরে ক্যাচটি লুফে নিয়েছেন ফিলিপস। ৫০ বলের ইনিংসে ১ ছক্কা মেরে ৩১ রান করেন গিল।
উদ্বোধনী জুটি ভাঙার ঠিক পরের ওভারে কোহলির উইকেট হারায় ভারত। ২০তম ওভারের প্রথম বলে ভারতীয় তারকা ব্যাটারকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। রান তাড়ায় ওস্তাদ কোহলি এবার ২ বলে ১ রান করে আউট হয়েছেন। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি। নিউজিল্যান্ডের স্পিনারদের ঘূর্ণিতে যখন ভারত হাঁসফাঁস করছে, তখন রোহিত নিজের উইকেটটা ছুড়ে এসেছেন। ২৭তম ওভারের প্রথম বলে রাচীন রবীন্দ্রকে উইকেট ছেড়ে রোহিত বেরিয়ে আসেন। নিউজিল্যান্ড উইকেটরক্ষক টম ল্যাথাম সহজেই স্টাম্পিং করেছেন। ৮৩ বলে ৭ চার ও ৩ ছক্কায় ৭৬ রান করেন রোহিত।

টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারকে হারিয়ে মুহূর্তেই বিনা উইকেটে ১০৫ রান থেকে ৩ উইকেটে ১২২ রানে পরিণত হয় ভারত। হঠাৎই খেই হারানো ভারত এরপর দিশা খুঁজে পায় অক্ষর প্যাটেল ও শ্রেয়াস আইয়ারের ব্যাটিংয়ে। চতুর্থ উইকেটে ৭৫ বলে ৬১ রানের জুটি গড়েন অক্ষর ও আইয়ার। ৩৯তম ওভারের চতুর্থ বলে আইয়ারকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন স্যান্টনার। ৪৪ রানে জীবন পাওয়া আইয়ার করেছেন ৪৮ রান। আরেক সেট ব্যাটার অক্ষরকে এরপর ফিরিয়েছেন ব্রেসওয়েল। ৪০ বলে ১ চার ও ১ ছক্কায় ২৯ রান করেন অক্ষর।
আইয়ার, অক্ষরের দ্রুত বিদায়ে ভারতের স্কোর হয়ে যায় ৪১.৩ ওভারে ৫ উইকেটে ২০৩ রান। নিউজিল্যান্ডের সামান্যতম একটু সম্ভাবনা তৈরি হলেও সেটা শেষ করে দেন রাহুল ও হার্দিক পান্ডিয়া। ষষ্ঠ উইকেটে ৩৬ বলে ৩৮ রানের জুটি গড়েন তাঁরা (রাহুল-পান্ডিয়া)। শেষ ১৫ বলে যখন ১১ রান দরকার, তখন পান্ডিয়াকে কট এন্ড বোল্ড করেন জেমিসন। তুলির শেষ আঁচড় রবীন্দ্র জাদেজা দিয়েছেন ৪৯তম ওভারের শেষ বলে ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে উইলিয়াম ও’রুর্ককে চার মেরে। ৬ বল হাতে রেখে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পর উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারতীয় ডাগআউট।
এর আগে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিয়ে নিউজিল্যান্ড ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৫১ রান করেছে। ইনিংস সর্বোচ্চ ৬৩ রান করেন ড্যারিল মিচেল। ১০১ বলের ইনিংসে ৩ চার মেরেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৩ রান করেন ব্রেসওয়েল। সাত নম্বরে নেমে ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। ৪০ বলের ইনিংসে ৩ চার ও ২ ছক্কা মেরেছেন ব্রেসওয়েল। ভারতের বরুণ চক্রবর্তী, কুলদীপ যাদব নিয়েছেন দুটি করে উইকেট। দুজনেই ১০ ওভার বোলিং করেছেন। বরুণ ও কুলদীপ খরচ করেন ৪৫ ও ৪০ রান। কেইন উইলিয়ামসনকে (১১) ইনিংস বড় করার আগেই ফিরিয়েছেন কুলদীপ। উইলিয়ামসন চোট পাওয়ায় পরে আর ফিল্ডিং করেননি।
জয়ের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া বলেন, “আইসিসি ট্রফি জেতা সব সময়ই আনন্দের। ২০১৭ সালে খুব কাছে গিয়ে পারিনি। এবার পারলাম, দারুণ তৃপ্ত লাগছে।”
চ্যাম্পিয়ন দলে হঠাৎ ডাক পাওয়া স্পিনার বরুণ চক্রবর্তীর অনুভূতি আরও আবেগঘন, “আমি সত্যিই ভাবিনি যে এমন কিছু হবে। এটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো!”
ভারতের সাবেক অধিনায়ক বিরাট কোহলির কণ্ঠে ঝরে পড়ে গর্বের সুর, ‘এই অনুভূতি অসাধারণ। অস্ট্রেলিয়ায় কঠিন সফরের পর আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছিলাম। তরুণরা এগিয়ে এসেছে, ভারতকে সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছে—এটাই সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।’
জয়ের প্রতিক্রিয়ায় হার্দিক পান্ডিয়া বলেন, ‘আইসিসি ট্রফি জেতা সব সময় আনন্দময়। ২০১৭ সালে খুব কাছে গিয়ে পারিনি। এখানে এসে পারলাম। আমি দারুণ তৃপ্ত।’
স্পিনার বরুণ চক্রবর্তী বলেন, ‘হঠাৎ করেই দলে এসেছি। আমি আশা করিনি যে এমন কিছু হবে। এটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার।’
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৫১/৭ (ইয়াং ১৫, রবীন্দ্র ৩৭, উইলিয়ামসন ১১, মিচেল ৬৩, ল্যাথাম ১৪, ফিলিপস ৩৪, ব্রেসওয়েল ৫৩*, স্যান্টনার ৮, স্মিথ ০*; শামি ৯-০-৭৪-১, পান্ডিয়া ৩-০-৩০-০, ভারুন ১০-০-৪৫-২, কুলদিপ ১০-০-৪০-২, আকসার ৮-০-২৯-০, জাদেজা ১০-০-৩০-১)।
ভারত: ৪৯ ওভারে ২৫৪/৬ (রোহিত ৭৬, গিল ৩০, কোহলি ১, শ্রেয়াস ৪৮, আকসার ২৯, রাহুল ৩৪*, পান্ডিয়া ১৮, জাদেজা ৯*; জেমিসন ৫-০-২৪-১, ও’রোক ৭-০-৫৬-০, স্মিথ ২-০-২২-০, স্যান্টনার ১০-০-৪৬-২, রাভিন্দ্রা ১০-১-৪৭-১ ব্রেসওয়েল ১০-১-২৮-২, ফিলিপস )।
ফল: ভারত ৪ উইকেটে জয়ী।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৪-এর পুরস্কার তালিকা-
চ্যাম্পিয়ন:- ভারত (ট্রফি ও ২.২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা)।
রানার্সআপ:- নিউজিল্যান্ড (ট্রফি ও ১.১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা)।
ফাইনালের সেরা ক্রিকেটার:– রোহিত শর্মা (৭টি চার ও ৩টি ছক্কার সাহায্যে ৮৩ বলে ৭৬ রান)।
টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার:- রাচিন রবীন্দ্র (৪ ম্যাচে ২৬৩ রান ও ৩টি উইকেট)।
গোল্ডেন ব্যাট (সব থেকে বেশি রান):- রাচিন রবীন্দ্র (৪ ম্যাচে ২৬৩ রান, ২টি হাফ-সেঞ্চুরি)।
গোল্ডেন বল (সব থেকে বেশি উইকেট):- ম্যাট হেনরি (৪টি ম্যাচে ১০টি উইকেট)।
উল্লেখ্য, প্রাইজ মানি ছাড়াও গ্রুপ লিগে প্রতিটি ম্যাচ জয়ের জন্য ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা করে বোনাস পয়েছে দলগুলো। ভারত গ্রুপ লিগে ৩টি ম্যাচ জিতেছে। যার অর্থ, ভারত গ্রুপ লিগের ৩টি ম্যাচ থেকে আয় করে বাড়তি প্রায় ৯০ লাখ টাকা।
এছাড়া টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিটি দল ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা করে পাচ্ছে। সেই নিরিখে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ১৯ কোটি ৫২ লাখ, ম্যাচ জয়ের বোনাস ৯০ লাখ এবং টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার ১ কোটি ৮ লাখ মিলিয়ে টিম ইন্ডিয়া পেয়েছে প্রায় ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
নিউজিল্যান্ড রানার্স হওয়ার জন্য ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড়াও গ্রুপ লিগের ২টি ম্যাচ জয়ের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা পকেটে পোরে। সেই সঙ্গে টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য কিউয়িরা পাচ্ছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। সুতরাং, এবারের টি-২০ বিশ্বকাপ থেকে নিউজিল্যান্ডের আয় ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।