:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি অনুমোদিত পথনকশায় অপেক্ষাকৃত সবল কোম্পানির সঙ্গে দুর্বল কোম্পানির একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার সময় এই উদ্যোগ নেয়া হল।
প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের একীভূত হওয়ার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বেসরকারি খাতের কোম্পানি ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক আজম জে চৌধুরী। দুই প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নাগরিক নিউজকে বলেন, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের পক্ষ থেকে একীভূত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। এখন দুই প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মিলে কীভাবে একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রাইম ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল উভয় প্রতিষ্ঠানের সম্মতিতে শর্তসাপেক্ষে একীভূতকরণের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে উভয় প্রতিষ্ঠানকে জানানো হবে। প্রতিষ্ঠান দুটির পরিচালনা পর্ষদে কর্তৃত্বে রয়েছেন জ্বালানি খাতের ব্যবসায়ী ও প্রাইম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা। আজম জে চৌধুরী ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে পরিচালক। তাঁর ছেলে তানজিল চৌধুরী প্রাইম ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান। আমানতকারীর জমা অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে না পারা, টানা পাঁচ বছর ধরে বড় লোকসানসহ বিভিন্ন সংকটে থাকা ইউনিয়ন ক্যাপিটালকে প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার মূল উদ্যোগ নেন আজম জে চৌধুরী।
একীভূত হবার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়ার ঘটনা হবে এটাই প্রথম। অবশ্য এর আগে ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংক কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। আর্থিক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদনের পর এখন একীভূতকরণ-পরবর্তী ইউনিয়ন ক্যাপিটালের আমানতকারীর অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে, তার পরিকল্পনা জানাতে হবে। এ ছাড়া সম্পদের মূল্যায়ন, মূলধন, ঋণ আদায় প্রক্রিয়া, কর্মীদের পুনর্বহালসহ সব বিষয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চুক্তি করতে হবে। তালিকাভুক্ত হওয়ায় এ বিষয়ে উভয় প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে ঘোষণা দেবে। সে আলোকে পুরো প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের লোকসান হয়েছে ৬২৮ কোটি টাকা। মূলত শেয়ারবাজারে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ করে লোকসানের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়েছে। ইউনিয়ন ক্যাপিটাল থেকে এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনিক্যাপ ইনভেস্টমেন্টে ঋণ রয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এ ঋণের বিপরীতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো আদায় নেই। এর বাইরে আরও কিছু ঋণ আটকে গেছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীর অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। বিএটি বাংলাদেশের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ১০৮ কোটি ২৫ লাখ টাকাসহ অনেক আমানত দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। এ কারণে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে আমানত পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সাবসিডিয়ারিতে নতুন ঋণ এবং সুদ মওকুফ বা অবলোপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাগরিক নিউজকে বলেন, বেশ আগে থেকে প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার চেষ্টা করে আসছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এতদিন নীতিমালা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি। এখন সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে একীভূতকরণের সায় পাওয়া গেছে। কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাইম ব্যাংকের আমানত রয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকার মতো। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ব্যাংকটি ২০২২ সালে নিট মুনাফা করে ৪০২ কোটি টাকা। ২০২১ সালে নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ৩১১ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ঋণ ও লিজ অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৩২০ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহক আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৪৮ কোটি টাকা। আগের বছর যা ৮৭৯ কোটি টাকা ছিল। ২০২৩ সাল শেষে আমানতের পরিমাণ আরও কমেছে বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে তেমন আমানত পাচ্ছে না। আগের বিতরণ করা ঋণ আদায় করে আমানতকারীদের কিছু কিছু ফেরত দিচ্ছে। ফলে আর্থিক প্রতিবেদনের আকার ছোট হচ্ছে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ৯ মাসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালে নিট লোকসান হয় ২০৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ছিল ১৩৯ কোটি টাকা। তার আগের বছর লোকসান ছিল ৪৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ১০৬ কোটি টাকা লোকসান হয়।
ইউনিয়ন ক্যাপিটালের বর্তমান চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র পরিচালক মুন্সি শফিউল হক। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের তালিকায় রয়েছে পলমল গার্মেন্টস, ইসি সিকিউরিটিজ, এনরিলকো লিমিটেড, খুরশিদা চৌধুরী, কাজী গোলাম সামিউর রহমান, ওয়াকার এ. চৌধুরী, মেহেরুননেসা হক, প্রকৌশলী এম আবু তাহের, আব্দুস সালাম, রুনা এন. আলম ও রুমানা শরিফ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক যুক্ত হয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে, সেই আদলেই ইউনিয়ন ক্যাপিটালের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রাইম ব্যাংক। সে ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী হয়ে দুই প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা পাঁচ বছর ধরে লোকসানে রয়েছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে বলা হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সহযোগী প্রতিষ্ঠানে নতুন করে সব ধরনের ঋণ বিতরণ, সুদ মওকুফ বা অবলোপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল আর্থিক কোনো অনিয়মের কারণে সংকটে পড়েনি। মূলত একসময় শেয়ারবাজারে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণে লোকসানি এ প্রতিষ্ঠানে নতুন করে বিনিয়োগ করে এটিকে আবার লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।