:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাতে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে ব্যাংক খাতের ওপর সিপিডি আয়োজিত সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো মালিকানা পরিবর্তনের পর দুর্বল হয়েছে। সেখানে গোষ্ঠীগত দুঃশাসন চলছে। নিজেদের স্বার্থেই সেখানে অলিগার্ক তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১২ সালের জুন মাস থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২২ সালে ডিসেম্বর প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। ওই সময়ে অবলোকনকৃত ঋণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। আর কোনো পুনঃতপশিলকৃত ঋণ ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ রয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এর বাইরেও মামলায় আটকে থাকা এক লাখ ৭৮ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা ফেরত আশা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা দেখিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কারণে ব্যাংক হাতের বিনিয়োগ কমেছে। এ জন্য তারা সরকারি বিভিন্ন বিলবন্ডে বিনিয়োগ করে মুনাফা দেখাচ্ছে। ব্যাংক যদি খেলাপি ঋণ তুলতে না পারে তখন তারা লোকসানে পড়ে। ওই সময় যদি সুদের হার বাড়তে থাকে তাহলে ব্যাংকগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। এতে ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়ে। সিপিডির এই শীর্ষ কর্তা বলেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের ক্যাশ হোল্ডিংস কমেছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো টাকা সংকটে ভুগছে।তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে ক্রমান্বয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সুশাসন জবাবদিহিতার অভাব। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের স্বাধীন সত্তা হারিয়েছে। এ কারণে ব্যাংক হাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের আগের অর্থমন্ত্রী হঠাৎ করেই সরকারি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত ছিল দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ। এখনো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নিয়ে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, সরকারি অ্যাসিড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গড়ে তোলা হবে। এসব কোম্পানিকে আর্থিক সহায়তা দেবে সরকার। এরপর ব্যাঙ্গালোর খারাপ দিনগুলো কিনে নেবে এ কোম্পানি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওই কোম্পানি যে ভালো হবে তার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা? ওই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অর্থ তো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেওয়া হবে। যদি ব্যাংকগুলো দেখে খারাপ ঋণগুলো এভাবে বিক্রি করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাহলে তারাও এই সুযোগ নিতে চাইবে। এটা একটা সাইকেল তৈরি হবে। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বেও এ সেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অর্থের জোগান নেয় বন্ড মার্কেট থেকে। কিন্তু আমাদের এখানে তো বন্ড মার্কেটই নেই।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, সরাসরি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৪৫ লাখ ৪৩৩ কোটি টাকা। এর বাইরে রাইট অফ বা অবলোপন, পুনঃতফসিলিসহ মন্দ ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা আটকে আছে। সব মিলিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। যার বড় অংশ ফেরত আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ মানে শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সকালে এক রকম নিয়ম করে, বিকেলে আবার আরেকজনের কথা শুনে তা পরিবর্তন করে। আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন দেওয়া আছে। তা অর্জন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সুদহার, ডলারের দর অনেক আগেই বাড়ানো দরকার ছিল। তা না করায় ভালো করতে গিয়ে মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, ডলারের দর বাড়িয়ে কিংবা সুদহার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি হবে না। প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প, কৃষিতে ঋণ বাড়াতে হবে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চলনায় সাবেক পরিকল্পমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসহ অনেকে সংলাপে অংশ নিয়েছেন।