:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তিন বছর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তাকে মনে করা হত একদিন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির উত্তরসূরি হবেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দেশটির প্রধান বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ইব্রাহিম রাইসির জন্ম ১৯৬০ সালের ১৪ ডিসেম্বর উত্তর-পূর্ব ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তেহরানের পার্শ্ববর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৮৯ থাকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন রাইসি। ২০০৪ সাল থেকে তিনি এক দশক জুডিশিয়াল অথোরিটির উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি।
কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট রাইসি পরবর্তীতে ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ সভার উপচেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এ সভা। ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তিনি ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানিকে পরাজিত করেন। অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন রাইসির পক্ষে প্রভাবিত করা হয়েছিল, কারণ তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাইসিকে প্রায়ই খামেনির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হয়। ইরানি রাজনীতিতে রাইসি একজন কঠোরপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত।
রাইসি ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মাশহাদের জুমা নামাজের ইমাম এবং ইমাম রেজা মাজারের প্রধান ইমাম আহমদ আলা মোলহোদার জামাতা।
তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা আটকে যায় এবং ২০২২ সালের শেষের দিকে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশটিতে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়। রাইসির সময় ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। এ ছাড়া ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।
১৯৮৮ সালে পাঁচ মাস ধরে তিনি রাজনৈতিক বন্দীদের মৃ্যুদণ্ডের একটি সিরিজ তত্ত্বাধানকারী একটি কমিটির অংশ ছিলেন। এর ফলে রাইসি ইরানের বিরোধীদের মধ্যে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ১৯৮৯ সালে তিনি ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর তেহরানের প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন।
খামেনির স্থলাভিষিক্ত আয়াতুল্লাহ খামেনির অধীনে রাইসির ক্রমাগত উত্থান ঘটতে থাকে।
রাইসি প্রথমবার ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যিনি পুনরায় নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন হাসান রুহানির বিরুদ্ধে। রুহানি বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির আলোচনার তত্ত্বাবধান করেছিলেন। নিষেধাজ্ঞা তোলার বিনিময়ে তাঁর পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করেছিলেন।
রাইসি সরকার, সামরিক এবং আইনসভার সমস্ত শাখার পাশাপাশি শক্তিশালী ধর্মতান্ত্রিক শাসক শ্রেণীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
ইরান বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, প্রসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করার পর থেকে তিনি ২০১১ সলে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সহিংস প্রতিক্রিয়ার আদেশ দেন যার ফলে ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
৬৩ বছর বয়সী ইব্রাহিম রাইসি ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ছয়টি প্রধান শক্তির সঙ্গে স্থগিত আলোচনায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইরানের ক্রমবর্ধমান উন্নত পারমাণবিক কর্মসূচিতে শুধুমাত্র ন্যূনতম নিষেধাজ্ঞার বিনিময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে উল্লেখযোগ্য ত্রাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছিলেন। প্রতিবেশী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং ওয়াশিংটনের সুইং পলিসির কারণে ইরানের কট্টরপন্থীদের কাছ থেকে বরাবরই উৎসাহ পেয়ে এসেছেন ইব্রাহিম রাইসি।
২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয় বড় শক্তির সঙ্গে তেহরান যে পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং ইরানের ওপর কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করে। জবাবে তেহরান ধীরে ধীরে চুক্তির পারমাণবিক বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করতে শুরু করে।
দেশীয় রাজনীতিতেও রাইসির কট্টরপন্থী অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তার নির্বাচনের এক বছর পর ইরানে হিজাব এবং সতীত্ব আইনের প্রয়োগকে কঠোর করা হয়।
এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর মাহসা আমিনি নামে এক তরুণ কুর্দি ইরানি মহিলা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যান। এর প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ফলশ্রুতিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তাকর্মীদের হামলায় প্রায় ৫০০ জন নিহত হয়। এ সময় দেশব্যাপী আটক করা হয় ২২ হাজার মানুষকে।
দুর্ঘটনায় রাইসির মৃত্যু হয়েছে কি না—তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এমন কিছু ঘটলে সেটা হবে ইরানের জন্য বড় ধাক্কা। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন।