স্বামীকে মৃত দেখিয়ে হাসিনার নামে মামলা করা নারী গ্রেফতার

■ সাভার প্রতিনিধি ■

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জীবিত স্বামী আল আমিন নিহত হয়েছেন দাবি করে শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা স্ত্রী কুলসুম বেগমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বাদী কুলসুমকে আটক করে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া এ ঘটনায় জড়িত মামলা বাণিজ্য চক্রের দুইজনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে থানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাদী দাবি করেছেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে ও নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে এ মামলা করানো হয়েছে।

শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক রকিবুল হাসান এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, শুক্রবার দুপুরে বাদীকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আটক অপর দুইজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

আটকরা হলেন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার টেপড়া গ্রামের রুহুল আমীন এবং ঘিওর থানার ফুলহারা গ্রামের শফিকুর রহমান।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার থেকে তাদেরকে আটক করা হয় বলে জানান আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর।

গত ২৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার স্বল্পসিংজুরি বাঙলা এলাকার আব্দুল খালেকের মেয়ে কুলসুম বেগম তার স্বামী আল আমিনকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় এটি এজাহারভুক্ত হয়। বর্তমান ঠিকানা দেখিয়েছেন আশুলিয়ার জামগড়া।

মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।

এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ৫ আগস্ট সকালে তার স্বামী আল-আমিন মিয়া (৩৪) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল ৪টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিলে তিনিও ছিলেন। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার স্বামী নিহত হন।

পরে জানা যায় আল আমিন আন্দোলনে নিহত হননি।

মামলার পর তিনি জানতে পারেন, তাকে মৃত দেখিয়ে স্ত্রী মামলা করেছেন। মামলা থেকে আসামির নাম প্রত্যাহার করার কথা বলে তার স্ত্রী লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সাও নিয়েছেন। পরে তিনি নিজে থানায় গিয়ে বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন।

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে আলোচিত এই ভুয়া মামলার কথা স্বীকার করেছেন বাদী কুলসুম বেগম।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেন, আল আমিনকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি সিলেটে থাকেন তিনি। দাম্পত্য কলহের জেরে সন্তানকে নিয়ে গত ২৮ আগস্ট সিলেট থেকে ঢাকার সাভারে বোনের কাছে চলে আসেন তিনি। পথে গাড়িতে শফিকুর রহমানের সঙ্গে তার দেখা ও কথা হয়। শফিক তাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে রুহুল আমিনের কাছে নিয়ে যান। সেখানে তার জন্মনিবন্ধন চেয়ে নেওয়া হয়। পরে একদিন সাভারের সেনা শপিং কমপ্লেক্সে শফিকুর রহমান ও রুহুল আমিন তাকে ডেকে নেন। পরে তারা জন্মনিবন্ধন দিয়ে একটি মামলা প্রস্তুত করেছেন বলে কুলসুমকে জানান।

কুলসুম বলেন, আমি রাজি না হলে নানা রকম ভয়ভীতি দেখায় তারা। পরে তারা আমাকে আদালতে নিয়ে উকিলের সামনে কাগজে স্বাক্ষর নেয়। এরপর পাঁচ লাখ টাকা ও প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার কথা বলে মামলাটি করানো হয়। রুহুল ও শফিকুর আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বাধ্য করেছে (মামলা করতে)।

তিনি জানান, সবশেষ তারা কক্সবাজারে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে বলেন তাকে। তাদের কথামতো তিনি সেখানেই থাকেন। ১৯ নভেম্বর শফিক কক্সবাজার আসেন। ২১ নভেম্বর পুলিশ রুহুল আমিনকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে তাদের আটক করে।

মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।

১২ নভেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে হাজির হন কুলসুম আক্তারের স্বামী আল-আমিন মিয়া। তাঁকে ‘নিহত’ দেখিয়ে মিথ্যা মামলা করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। পুলিশকে তিনি বলেন, স্ত্রী কুলসুমকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় থাকেন। গত ৫ আগস্ট কুলসুম তাঁর সঙ্গে সিলেটেই ছিলেন। এর কয়েক দিন পরে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে কুলসুম মানিকগঞ্জ ঘিওরে তাঁর (কুলসুম) বাবার বাড়িতে চলে যান। এর পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ‘নিহত’ দেখিয়ে মামলা করেছেন।

কুলসুম আরও বলেন, ‘মিথ্যা মামলার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর রুহুল আমিন ও শফিকুল আমাকে কক্সবাজার নিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখেন। তাঁরা আমার মোবাইল নিয়ে নেন। এ সময় তাঁরা আমাকে তিন-চারজনকে দিয়ে ধর্ষণ করিয়ে বিচে ফেলে রাখার প্ল্যান করেন। উদ্ধার হওয়ার পর যাতে আমি বলি মামলার আসামিরা আমাকে ধর্ষণ করেছেন। আমি তাতে রাজি না হলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন পরে নানা ভয়ভীতির মুখে আবার আমাকে কক্সবাজার যেতে বাধ্য করা হয়। তারা আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিল।’

আশুলিয়ার ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী সরকার বলেন, ‘কুলসুমের মামলায় আমি ৫৭ নম্বর আসামি। হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার বিষয়টি জানার পর আমি রুহুল আমিনের ছেলে কাউসারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দেন। এর পরে মামলা থেকে নাম কাটানোর জন্য টাকা দাবি করেন। আমি প্রথমে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দেই। পরে আরও ২০ হাজার টাকা দেই। আমার মতো আরও ২৫ জনে মিলে তাঁকে ২৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা দিয়েছেন।’

পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন ও শফিকুল সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানোর জন্য কুলসুম এসব অভিযোগ করছেন।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *