■ কূটনৈতিক প্রতিবেদক ■
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের শেষ দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়েছে।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বা বাংলাদেশ অন্যান্য যেসব বিষয় তুলে ধরেছে সেসব বিষয়ে ভারত কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সে সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারপ্রধানের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে তা জানতে চান সাংবাদিকরা।
জবাবে বিক্রম মিশ্রি স্বীকার করেন যে এ ইস্যুতে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে, তবে কী কথা হয়েছে— সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে।’
প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ এবং ভারতে বসে তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, এসব বিষয় বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তে হত্যা, তিস্তা নদীর পানি বন্টনসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শুরুতে ভারতের ধারণা ছিল এটা একটা ‘স্টপওভার’ আর তার মেয়াদ বড়জোর ছয়-সাত ঘণ্টা। সেই ভুল ভাঙতে অবশ্য দিল্লির সময় লাগেনি। প্রায় ৮ মাস হতে চললেও শেখ হাসিনাকে এখনও পাঠানো সম্ভব হয়নি তৃতীয় কোনো দেশে– এবং রাষ্ট্রের অতিথি হিসেবে তিনি আজও ভারতেই অবস্থান করছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথমবারের মতো অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হলো। এর আগে গতকাল বিমসটেক সম্মেলনের নৈশভোজে দুই নেতার সাক্ষাৎ হয় এবং তারা কুশলাদি বিনিময় করেন। নৈশভোজে উভয় নেতাকে বেশ কিছু সময় ধরে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখা গেছে।
বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোটের (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলন ২ থেকে ৪ এপ্রিল ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এটি অবশ্য নির্ধারিত কোনো বৈঠক ছিল না; অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি কিংবা ড. মুহম্মদ ইউনূস— কারো সফরসূচিতেই এ বৈঠকের উল্লেখ ছিল না। দুই দেশের কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব হয়েছে দুই নেতার সাক্ষাৎ।
ভারতের দ্য হিন্দু জানিয়েছে, ড. মুহম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের স্থায়িত্ব ছিল ৪০ মিনিট। পরে নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিক্রম মিশ্রি মন্ত্রণালয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বৈঠকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনে ভারত সবসময় সহযোগিতা করবে। তিনি আরও বলেছেন যে ভারত দুই দেশের জনগণকেন্দ্রীক সম্পর্ক চায় এবং বিশ্বাস করে যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে দুই দেশের জনগণ।”
“প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক চায় ভারত। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশটির সরকারপ্রধানকে অনুরোধ করেছেন তিনি। পাশাপাশি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে কলুষিত করতে পারে— এমন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন।”
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ৭ রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ইউনূস। ভারতের রাজনীতিবিদরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা বয়ে এনেছে। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।
বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন, পরিবেশকে খারাপ করে, এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।
এর আগে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যকে ‘ল্যান্ডলকড’ বা ভূবেষ্টিত আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ভারতের এই রাজ্যগুলোর সমুদ্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে একমাত্র অভিভাবক বাংলাদেশ। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি ভারত।
এর পাল্টা জবাব দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। ড. ইউনূসের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেভেন সিস্টার্সকে বিমসটেকের কেন্দ্রবিন্দু দাবি করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘আন্তঃআঞ্চলিক গোষ্ঠীর’ (বিমসটেক) কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত, যা এই অঞ্চলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর প্রাধান্যকেই তুলে ধরে। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘বিমসটেকের জন্য একটি সংযোগ কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে।
বিক্রম মিশ্রি জানান, সীমান্তে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ, বিশেষ করে, রাতে সীমান্ত অতিক্রম ঠেকানো সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পর্যালোচনা ও এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সদস্যদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়েও অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন। জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে আমরা একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে পাব। এ ব্যাপারে নির্বাচনের একটি ভূমিকা রয়েছে, তা সবাই জানেন।’