:: সাইফ হাসনাত ::
২০১৫ সালের কথা। টুইটারে তাকে খুঁজে বের করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। কারণ আমি লিখছিলাম Irfan Khan, কিন্তু তিনি তো আর অন্য দশজন Irfan এর মতো নন, তার নামের বানানেই যেনো মূর্ত হয়ে ছিলো এই সত্য- Irrfan Khan; ডাবল আর।
খুঁজে বের করে ফলো বাটনটা প্রেস করার কিছুক্ষণ পরই তার আইডি থেকে একটা মেসেজ এলো। ডিএম বা ডাইরেক্ট মেসেজ। আমি তো অবাক! আমাকে মেসেজ পাঠালেন ইরফান খান! নাহ, তিনি আমাকে মেসেজ পাঠাননি। আবার এক অর্থে তিনিই পাঠিয়েছিলেন। কারণ অটো ওই মেসেজটা তো সেট করে রেখেছিলেন ইরফান খান নিজেই।
মেসেজটা ছিলো- Lets add to the noise or the music. Choice is completely yours, whatever makes you feel the way you want to feel. Thanks for following.
জ্বি ইরফান, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আমরা কী বেছে নিবো, তার ভার শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতেই। আপনিও যেমন আপনার ভাগ্য গড়ে নিতে চেয়েছিলেন নিজের মতো। টায়ার বিক্রেতার ছেলের পরিচয় থেকে বের হয়ে হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার হতে। হয়তো প্রতিটি ভারতীয় তরুণই জীবনে অন্তত একবার হলেও ক্রিকেটার হওয়ার সিরিয়াস চেষ্টা করে।
আপনার সেই চেষ্টা বৃথা যায়। আপনি এরপরও নিজের পছন্দকেই বেছে নিতে চেয়েছেন। করেছেন ব্যবসা। সুবিধা হয়নি। এরপর হয়েছেন অভিনয়ে। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আপনি বন্দি হয়ে ছিলেন টিভি অভিনয়ে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না দেখে আপনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি তো অভিনয়ে এসেছি গল্প বলতে, সিনেমা করতে, কিন্তু বন্দি হয়ে আছি টিভিতে।”
আপনার চোখ দুটি ছিলো গভীর ও বিস্ময়কর। এই রকম চোখের মানুষ দুনিয়াতে কম। আপনার নামের বানান আর আপনার আলাদা রকমের চোখ আসলে ছিলো আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। আপনাকে তাই কোনো দিন কোনো চরিত্র অন্য কারোর মতো মনে হয়নি। আপনার বড় নামটা- সাহেবজাদে ইরফান আলি খান- বলিউডের চেনা শব্দ ‘খান’ দিয়ে শেষ হলেও, আপনি কোনো খানের মতো ছিলেন না, আপনি ছিলেন আলাদা খান। লোকে আপনাকে ফোর্থ খান বলতো, কিন্তু আপনি আসলে ছিলেন দ্য ডিফারেন্ট খান।
আবার আপনি যে অন্যদের মতো ভাবতেন না, তা ও নয়। সোপ অপেরায় বন্দি থাকতে থাকতে এক সময়- ধুর হবে না, বলে আপনি সব কিছু ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। অন্য অনেকের মতো বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলেন আপনিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি টিকে গেলেন। এবং এতোটা প্রতাপশালী সেই টিকে যাওয়া যে বলিউডের পাশাপাশি হলিউডও আপনার পায়ের কাছে এসে মাথা নুইয়ে দিলো।
সেই তুলনায় আমাদের ঢালিউড তো কিছুই না। তারপরও আমাদের কী সৌভাগ্য, আপনি একটা বাংলা ছবিও করে ফেললেন। আমাদের দেশেরই পরিচালকের! সেই খবর প্রথম শোনার পর বিস্ময়ের অন্ত ছিলো না।
শেষ পর্যন্ত আপনি আলাদা ছিলেন। হ্যা, ছিলেন বলতেই হচ্ছে। আবার এটা না বললেও হয়। কারণ মৃত্যু এসে আপনাকে অন্য জগতে নিয়ে গেলো ঠিক, কিন্তু আপনার আলাদা হওয়া তাতে মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত নয়। আপনি আলাদাই থাকবেন।
বলিউডকে কেনো বলিউড বলা হয়, এ নিয়ে আপনার আপত্তি ছিলো। বলিউডকে বলিউড বলে আসলে হলিউডের অনুকরণ করা হয়, এই নিয়ে আপনার আপত্তি ছিলো। ভারতীয় সিনেমার টেকনিক আলাদা, ভাব ও ভাবনা আলাদা, তবে নাম কেনো হলিউডের মতো হবে; এই ছিলো আপনার প্রশ্ন।
আপনি আসলে কতোটা আলাদা ছিলেন, এই কথায়ই তা স্পষ্ট। মারণব্যাধী শরীরে বাসা বাধার পরই আপনি অন্য যে কোনো মানুষের মতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আবার আপনি যেহেতু আপনি, সেহেতু শিড়দাঁড়া উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ভাগ্যের অমোঘ সত্যের সাথে তো আর লড়াই চলে না, ঘুরে দাঁড়ানো এখানে অর্থহীন; আপনাকে তাই চলে যেতেই হলো যখন পৃথিবী এমনিতেই স্তব্ধ হয়ে আছে মারণভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে।
এখন প্রতিটি মৃত্যুই যেনো স্বাভাবিক। প্রতিটি মৃত্যুই যেনো কারো না কারো অপেক্ষার অবসান। কিন্তু আপনার মৃত্যু? আপনার মৃত্যু আলাদা কোনো তাৎপর্য বহন করে?
টুইটারের ওই অটো মেসেজের একটি কনভার্সেশন ছাড়া, আপনার সাথে আর কোনো রকম দূরতম যোগাযোগও আমার নেই। অথচ এই লেখাটা যখন লিখছি, মনে হচ্ছে আপনাকে সামনে বসিয়ে এসব বলছি।
কোথায় যেনো কিছুদিন আগে পড়লাম, যারা মরে যায়, তারা তো বেঁচেই যায়, কষ্টটা তাদের, যারা বেঁচে থাকে। আপনি অগণন যে ভক্তকুল, অনুরাগী, সহকর্মী রেখে গেলেন, তাদের কষ্টের বেতারে আজ বাজবে শুধু বেদনার ভায়োলিন; এ কথা না বললেও হয়। মৃত্যুর জগত থেকে আপনি তা জানবেন না হয়তো। কিন্তু কি জানি- হয়তো সেখান থেকেও সব জানা যায়।