মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সত্য ও মুক্তি-পিয়াসী। আর মহান আল্লাহই মানুষের মধ্যে দান করেছেন এই প্রকৃতি। তবে এই প্রকৃতিকে ব্যবহার করা বা ন করা মানুষের ইচ্ছাধীন ব্যাপার। মানুষকে আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন মানুষ যদি সেদিকেই অগ্রসর হতে না পারে তবে তারা কখনও প্রকৃত সুখ ও শান্তি পায় না। সত্য ও হেদায়াত বা সুপথ প্রদর্শনের উৎস হলেন মহান আল্লাহ।
কেবল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্তরাই হেদায়াতের আলো পেয়ে থাকেন। কলুষিত হৃদয় বা অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হেদায়াতের আলো স্থান পেতে পারে না। সূরা নূরের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উপমা হল একটি তাক সদৃশ যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, আর প্রদীপটি আছে এক কাঁচের ফানুসের মধ্যে এবং ফানুসটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ; সেটা (প্রদীপ) এমন প্রাচুর্যময় জয়তুন বৃক্ষের তেলে প্রজ্বলিত হয়, যা না প্রাচ্যের, আর না প্রতীচ্যের, ওর তেল যেন এক্ষণই প্রজ্জ্বলিত হবে যদিও তাতে অগ্নিসংযুক্ত না হয়; জ্যোতির ওপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথ প্রদর্শন করেন এবং আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করেন; বস্তুত আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।”
খোদায়ী হেদায়াতের আলোয় সত্য-সন্ধানী মানুষ জীবনের বাস্তবতা খুঁজে পায়। ঈমানহীন অবস্থা থেকে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ উপভোগকারী ব্যক্তির অবস্থাকে এমন ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা যায় যে মরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেলার পর অনেক খোঁজাখুঁজির মাধ্যমে আবার পথে ফিরে আসে, কিংবা অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলার পর আলোর সন্ধান পায়। এমন ব্যক্তি যেন পুনর্জন্মের অনুভুতি লাভ করেন।
মাল্টার নও-মুসলিম ইউসুফ আবদুল্লাহ(Yusuf Abdullah) বা সাবেক জোসেফ জামিত (Joseph Zammit) ছিলেন এমনই একজন সত্য-সন্ধানী। তিনি বলেছেন, “শৈশবেই আমার হৃদয়ে ছিল স্রস্টা বা আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা। ধর্ম ও আধ্যাত্মিক বিষয় আমাকে গভীরভাবে টানতো। আমার মা যখন ঘরের কাজকর্ম করতেন তখন আমি তাকে হযরত ঈসা মাসিহ’র বন্ধুদের জীবন-কাহিনী শোনাতাম। অবসর সময়ে পড়তাম অতি প্রাচীন যুগের নবী-রাসূলদের কাহিনী। হযরত ঈসা (আ.) এর ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র ছিলো আমার খুবই প্রিয়। স্কুলের ক্লাসগুলোর মধ্যে বাইবেলের ব্যাখ্যার ক্লাসেও যেতাম। কিন্তু কিছু দিন পরই মনে হলো বাইবেলের সুন্দর বক্তব্যগুলোর কিছু অংশ হারিয়ে গেছে। তাই গির্জার দেয়া পাঠ বা শিক্ষাগুলোকে আর মেনে নিতে পারছিলাম না। কারণ, সেগুলো আমাকে মোটেই প্রভাবিত করতো না। আমার কাজ সঁপে দিয়েছিলাম আল্লাহর হাতে। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে আমি খোদাকে খুঁজছিলাম। আল্লাহকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতাম। আর আল্লাহও আমাকে এ পথে সাহায্য করেছেন।”
নও-মুসলিম ‘ইউসুফ আবদুল্লাহ’ বা সাবেক জোসেফ জামিত আরো বলেছেন, “সত্য অনুসন্ধানের প্রেরণা বেড়ে যাওয়ার পর আমি বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আদর্শ ও মনোস্তাত্তিক আদর্শ নিয়ে গবেষণা শুরু করি। প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করি। একই সময়ে তাসাওউফ নিয়েও গবেষণা করতে থাকি। এর মধ্যে ইতিবাচক কিছু বিষয় দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এর মূল বা শেকড় ইসলামে প্রোথিত বলে তা এড়িয়ে গেলাম। কারণ, আমি শুনেছিলাম যে ইসলাম খুবই রূক্ষ্ম বা উগ্র ধর্ম ও স্বাধীনতার বিরোধী। হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধক, খ্রিস্টানদের নানা গ্রুপ ও এরফান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি। এইসব পড়াশুনা আমাকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের দিকে টেনে নেয়। ব্যাপক পড়াশুনা করলাম। কিন্তু সব সময়ই ইসলামের সরলতা ও আল্লাহর প্রতি মুসলমানদের গভীর ভালোবাসা আমাকে আকৃষ্ট করতো।”
ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও সাবেক জোসেফ জামিত হৃদয়ের গহীনে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন। আল্লাহ বা প্রকৃত স্রস্টাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার মধ্যে যে আকুতি ছিল মহান প্রভু তার জবাব দিয়েছিলেন তাকে সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গতম ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের সঙ্গে পরিচিত করে।
ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে নও-মুসলিম ‘ইউসুফ আবদুল্লাহ’ বা সাবেক জোসেফ জামিত বলেছেন,“মাল্টার মতো ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশে মুসলমান হওয়াটা বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই আমি আরো বেশি গভীর উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সুপথ বা হেদায়াত পাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেছি। আমার ভেতরের আকুতি যখন চরমে পৌঁছে তখনই শতভাগ বিস্ময়ে চোখ খুলে দেখি যে আমি কুরআন অধ্যয়নে মশগুল হয়েছি। অতীতের নবী-রাসূলদের সম্পর্কিত কুরআনের বর্ণনার সঙ্গে বাইবেলের বর্ণনার অনেক মিল দেখতে পেলাম। তাই আমার নিজেকে নিয়েই আমার হাসি পেলো এবং নিজেকে বললাম, এতসব গবেষণার পরও কেনো কুরআনের দিকে যাই নি?”
নও-মুসলিম ‘ইউসুফ আবদুল্লাহ’ আরো বলেছেন, “কুরআন পাঠ আমার জীবনের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ইসলামের প্রধান স্তম্ভ তথা নামাজ, রোজা, হজ্ব-ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং মহান আল্লাহর সহায়তায় এতটা শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করি যে শেষ পর্যন্ত ইসলামে দীক্ষিত হলাম।”
হজ্ব অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ইউসুফ আবদুল্লাহকে এত মুগ্ধ করেছিলো যে তিনি এই মহতী সম্মেলনে যোগ দিতে চেয়েছিলেন যাতে খুব কাছ থেকে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছিলেন পুরোপুরি মুসলমান হওয়ার পরই যেনো তিনি এই অনুষ্ঠানে শরিক হন।
এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ বলেছেন, “হজ্বে যোগ দেয়ায় মাত্র এক সপ্তাহ আগে কাকতালিয়ভাবে এক মসজিদে এক ব্রিটিশ মুসলিম দম্পতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। আমাদের মধ্যে খুব চমৎকার মত বিনিময় হয়। তারা আমাকে কয়েকটি বই উপহার দেন। ওই মূল্যবান বইগুলো পড়ার সুবাদে আমি ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করি এবং পরিপূর্ণ ও দৃঢ় ঈমানের আলো নিয়ে হজ্ব-যাত্রা শুরু করি।”
হজ্ব আধ্যাত্মিকতার বসন্ত ও খোদাপ্রেমের ঐশী আলোয় অবগাহনের এবং পাপ মোচনের অসাধারণ সুযোগ। হজ্বে ভ্রাতৃত্য ও সাম্যের প্রাণবন্ত ঔজ্জ্বল্য অন্য অনেক নওমুসলিমের মতো ইউসুফ আবদুল্লাহকেও দারুণভাবে অভিভুত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংগ্রামী মুসলিম নেতা ম্যালকম এক্স হজ্বের স্মৃতি কথায় লিখেছেন:
“এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও হৃদ্যতার অনুভুতি নিয়ে পরস্পরের পাশে সমবেত হতে আর কখনও দেখিনি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সহ বহু নবীর পূণ্য স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাচীন শহরে সব বর্ণ, ভাষা ও জাতির মানুষ সমবেত হয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এতোটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি যে কথা বলার ও বক্তৃতা দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।”
মাল্টার নও-মুসলিম ইউসুফ আবদুল্লাহ ঈমানের আকর্ষণ ও আল্লাহর মদদ কী তা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি মন ও চিন্তার জানালাগুলো খুলে রাখার এবং নিজেদের বিষয়গুলো আল্লাহর হাতে সঁপে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সবাইকে। খোদায়ী হেদায়াত পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ও আন্তরিক হতে হবে বলে আবদুল্লাহ মনে করেন।
তিনি বলেছেন, “পার্থিব বিষয় আশয় ও জাঁকজমক- এসব থাকা সত্ত্বেও সব সময়ই ছিলাম পথহারা। আল্লাহর অস্তিত্ব আমার জন্য এমন এক বড় উপহার যে তাঁরই দয়ায় আমি আমার পরবর্তী জীবনে প্রশান্তিতে ও নিশ্চিন্তে কাটানোর সুযোগ পেয়েছি।”