:: তাহসিন আহমেদ ::
বাসায় সাদিয়ার সন্ধানে আসা মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় তখন এক চিলতে হাসি।
আনমনে আমার বারবার মনে হচ্ছিল– সাদিয়া নামে তো এই বাসায় কেউ থাকে না, তাহলে এই মেয়েটি কে?
: ভাইয়া, সাদিয়া না থাকলে বলেন চলে যাই। আমার একটু পরেই টিউশনে যেতে হবে।
: সাদিয়া নামে কেউ এই বাসায় থাকে না। কেন বিরক্ত করছেন?
: আচ্ছা, চলে যাচ্ছি। সাদিয়া এলে বলবেন মালিহা এসেছিল। আমি ওর স্কুলের বান্ধবী। ২০১১ ব্যাচ।
: সাদিয়া থাকলে তো বলবো। একই কথা বার বার বলে যাচ্ছেন! আপনি চলে গেলে খুশি হবো।
: আচ্ছা, গেলাম; তবে আবার আসবো। আপনাকে জ্বালাতে। ভালো থাকবেন, গেলাম।
দ্রুত গতিতে মেয়েটি আমাদের বাসার প্রধান ফটক অতিক্রম করলো। ফিরেও তাকালো না।
আচ্ছা সাদিয়া কে? এই নামে কি কেউ আদৌ ছিল? নাকি ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম…
ঘড়িতে সময় সকাল ১০:৩০ মিনিট। আজ শনিবার। বলতে গেলে তেমন কাজ নেই। কারণ আজ আমার ডে অফ।
আমাদের পেছনে সাইদ, করিম ভাই এবং মজিদের মহাজনসহ বাকিরা। তাদের কাছে মনে হয় আমাদের ভালোবাসা এড়ানো যাবে না। সাইদ হঠাৎ আমাদের যুগল ছবি তুলতে শুরু করলো। মালিহার চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। আর আমি এমন বিব্রতকর মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত থাকায় মুখ দিয়ে কোনো কথা বলতে পারলাম না। করিম ভাই শুধু মালিহাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন– সাংবাদিকতা করবে নাকি ওকালতি করবে? ওকালতি করলে কিন্ত এক সাথে, কাছাকাছি, পাশাপাশি অনেকটা পথ হাঁটার সুযোগ থাকবে না! মালিহার মুখে তখন লাজুক এক চিলতে হাসি।
২.
সকাল সকাল পত্রিকা অফিস থেকে ফোন। এখানে বলে রাখি– আমি একটি দৈনিক পত্রিকায় জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছি। ফোন করেছেন পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক আহমেদ করিম। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে তিনি আলাপ করতে চান। আমার গন্তব্য এখন দৈনিক আলোড়ন পত্রিকা অফিসে।
রাশভারী মানুষ হিসেবে পরিচিত আহমেদ করিম মোটা ফ্রেমের চশমা পড়েন। কোনো কারণ ছাড়াই দুই কানের ওপর সবসময় দুইটি কলম লাগিয়ে রাখেন। যদিও তিনি সব কাজ মূলত কি-বোর্ডের সাহায্যে টাইপ করেই করেন।
: সামি, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটেছে। এটি নিয়ে তোমাকে নিউজ করতে হবে। সাধারণ এক সিএনজি ড্রাইভারকে খেলাপি ঋণের মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এই লোকের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত নেই। ঘটনার মূল নায়ক একটি বড় বাবসায়ী গ্রুপের মালিকের শ্যালক। আমাদের খুব দ্রুত এই ঘটনার এক্সক্লুসিভ স্টোরি করতে হবে, লিড নিউজ হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেয়ার জন্য। খুব দ্রুত তোমাকে এগোতে হবে।
: করিম ভাই, আমার তো এই ঘটনার কোনো সোর্স নেই। দ্রুত এগোনোর জন্য কীভাবে কাজ শুরু করবো?
: দাড়াও, আমাদের পত্রিকায় মালিহা চৌধুরী নামে নতুন একটা মেয়ে গতকাল জয়েন করেছে, শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক হিসেবে। তোমার কাল ডে অফ ছিল, তাই জানাতে পারিনি।
৩.
দৈনিক আলোড়ন পত্রিকার শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক হিসেবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মালিহা চৌধুরীর ডাক পড়লো কনফারেন্স রুমে। আমার সঙ্গে আহমেদ করিম ছাড়াও বসে আছেন পত্রিকার প্রধান আলোকচিত্রী সাইদ ইরফান এবং প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুল বাসেত হিরু। এক্সক্লুসিভ স্টোরিটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং আলোচনা চলছে। এরই মাঝে করিম ভাই মালিহাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো–
: মালিহা, তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই। আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার সামিউল হাসান। তোমার প্রথম অ্যাসাইনমেনটে সে তোমাকে সাহায্য করবে।
মেয়েটিকে দেখেই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। এই মেয়েই সাদিয়ার সন্ধানে আমাদের বাসায় এসে বলেছিল– আবার আমাকে জ্বালাতে আসবে। কোন ব্যাচ যেন বলেছিল মনে করতে পারলাম না।
মালিহার মুখে তখন মুচকি হাসি। আসলে এই মেয়ে কে, কেন এসেছিল সাদিয়া নামের কারও সন্ধানে আমাদের বাসায়? আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো।
৪.
আমার, মালিহার ও সাইদের গন্তব্য এখন ঢাকার একটি সিএনজি গ্যারেজ। সিএনজি ড্রাইভারকে খেলাপি ঋণের মামলায় ফাঁসানো সংক্রান্ত এক্সক্লুসিভ সংবাদের আসল রহস্য উন্মোচন আমাদের আজকের মূল কাজ। কৌশলের অংশ হিসেবে আমাদের সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে নিজেদের মানবাধিকার কর্মী সাজিয়ে সিএনজি ড্রাইভার মজিদের মহাজন সাইফুদ্দিন ব্যাপারীর কাছে গেলাম। বিমর্ষ মুখে গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবছিলেন তিনি।
: বলেন, কী জানতে চান?
সাইফুদ্দিন ব্যাপারীর কণ্ঠে ক্ষোভ এবং মুখে রাজ্যের হতাশা।
মালিহা শুরুতেই বলে উঠলো–
: আমি মানবাধিকার কর্মী সাবিহা। এই কেসের ব্যাপারে মজিদকে আইনি সহায়তা করতে চাই।
মেয়েটির উপস্থিত বুদ্ধি দেখে আমি মনে মনে বাহবা দিলাম।
: আসল ঘটনা কী সেটি জানতে চাই। আমি দ্রুত মালিহার কথার সঙ্গে যোগ করলাম।
: বড়লোকের বেটা সাদির শ্যালক মামুন ১ কোটি টাকা কর্জ করে ভুয়া ঠিকানা হিসেবে আমার গ্যারেজ আর জমির ঠিকানা ব্যবহার করে। টাকা কর্জ নেয় মজিদের নামে। সাদি শ্যালককে বাঁচাতে মজিদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকার লোভ দেখিয়েছিল। মজিদ রাজি হয়নি বলে ফাঁসিয়ে চৌদ্দ শিকের ভেতর নিলো। শুয়োরের দল।
: আপনারা উকিল ধরেননি? মালিহা প্রতি উত্তরে বলে উঠলো।
: বড়লোকের বেটা সাদির বিরুদ্ধে কোনো উকিল দাঁড়াবো না।
আমাদের প্রথম দিনের কাজ শেষ। এখন যেতে হবে মজিদের কাছে। কিন্তু এখন সম্ভব না। আগামীকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মজিদের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু আরও ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।
৫.
আমি আর মালিহা কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখন জানলাম মালিকা অনার্স সম্পন্ন করেছে আইন বিভাগ থেকে। বার কাউন্সিল পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ। একটা আইনজীবীর চেম্বারে অনিয়মিত বসতো। পরে সেটি ছেড়ে সাংবাদিকতা করবে বলে আমাদের পত্রিকার শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক হিসেবে জয়েন করে।
দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে আমারা কারাগারে মজিদের সাক্ষাৎ পাই। সে ভেবেছিল তাদের ভাষায় বড়লোকের বেটা সাদির লোক আমরা। পরে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
সাতদিন কারাগারে কয়েদি হিসেবে থেকে মজিদের ক্ষোভ সব সাদির শ্যালক মামুনের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়লো। ক্রমাগত ১০ মিনিট সে অল্প স্বরে মামুনকে গালি দিয়ে গেলো। মামুনের ঠিকানা মজিদের মুখস্থ। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমি মালিহাকে নিয়ে রওনা দিলাম মামুনের কাছে।
মামুনকে ফাঁদে ফেলে যে কোনোভাবে আমাদের মূল সত্য বের করা লাগবে।
মালিহার বুদ্ধিমতো আমরা স্বামী-স্ত্রী সেজে ব্যবসায়ী পরিবারের মানুষ হিসেবে একটা রেস্টুরেন্টে মামুনের সঙ্গে দেখা করলাম। মালিহার মোবাইল ফোনের রেকর্ডার চালু করা ছিল। আমাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওয়েটার স্যুপের বাটি ইচ্ছা করে মামুনের ব্লেজার বরাবর ফেলে। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মামুন। মারতে উদ্দ্যত হয় ওয়েটারের বেশ নেয়া আমাদের পত্রিকার আলোকচিত্রী সাইদ। গোপন ক্যামেরা সাইদের শার্টের পকেটের কোনো একটা অংশে লাগানো ছিল।
মামুনকে আরও বেশি রাগাতে সাইদ বলে ওঠে– ‘একটু চেপে বসলে তো স্যুপ গায়ে পড়ত না।’ গালি দিতে শুরু করে মামুন। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ওঠে– ‘মজিদের মত তোকেও জেলের ভাত খাওয়াবো। এখনও আমাকে চিনিস না।’
আমি আর মালিহা উত্তেজিত। মামুনের পেট থেকে কথা বের করতে জিজ্ঞেস করি এই মজিদ কে? বেশ রেগে যাওয়ায় মামুন মনের অজান্তেই বলে ওঠে– ‘আর বইলেন না ভাই, সিএনজি ড্রাইভার একটার নাম মজিদ। দুলাভাইকে ফাঁসাতে মজিদের ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক লোন নিছিলাম। এখন তো পড়ছি গ্যাঁড়াকলে। মজিদকে ভেতরে নিলো দুলাভাইটা। পোলাডার কোনো দোষ ছিল না। ১০ হাজার টাকা সাধছিলাম। হালায় নিলোই না। দিলাম ভইরা ভেতরে। দুলাভাইও খুশি, আমিও খুশি।’
মালিহার মুখে বিজয়ীর হাসি। আমার মধ্য তখন বাঁধভাঙা উল্লাস। এত দ্রুত এত কঠিন কাজ করা যাবে আমি মালিহা– কেউ ভাবতে পারিনি।
৬.
সাদির শ্যালক মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করানো হয় মজিদের মহাজন সিএনজি গারেজের মালিক সাইফুদ্দিন ব্যাপারীকে দিয়ে। মামলায় মজিদের আইনজীবী হিসেবে তার জামিনের আবেদন করে আমাদের পত্রিকার শিক্ষানবিশ সাংবাদিক ও আইনজীবী মালিহা চৌধুরী। হাইকোর্ট থেকে জামিন পায় মজিদ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত মজিদের জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে সাইফুদ্দিন ব্যাপারী এবং তার গ্যারেজের সব সিএনজি ড্রাইভার। আমাদের প্রধান আলোকচিত্রী সাইদ তখন মজিদের বিজয়ীর বেশে মুক্তির আনন্দ লাভের ছবি তোলায় ব্যস্ত।
মালিহা তখন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। আমি এগিয়ে গেলাম। বলে উঠলাম–
: তোমার সঙ্গে আরও অনেক পথ একসাথে হাঁটতে চাই। যদি তুমি চাও।
অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চুপ ছিল মালিহা। সন্ধ্যা তখন ৬.৩০। আরও ১০ মিনিট এভাবে চুপ থেকে বলতে কথা শুরু করে মালিহা–
: এক সাথে নকল স্বামী-স্ত্রী হয়ে যেদিন মামুনের ঋণ কেলেঙ্কারির রহস্য উন্মোচন করেছিলাম, সেদিনই তো একসাথে অনেকটা পথ চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি!
আমাদের পেছনে সাইদ, করিম ভাই এবং মজিদের মহাজনসহ বাকিরা। তাদের কাছে মনে হয় আমাদের ভালোবাসা এড়ানো যাবে না।
সাইদ হঠাৎ আমাদের যুগল ছবি তুলতে শুরু করলো। মালিহার চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। আর আমি এমন বিব্রতকর মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত থাকায় মুখ দিয়ে কোনো কথা বলতে পারলাম না।
করিম ভাই শুধু মালিহাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন– সাংবাদিকতা করবে নাকি ওকালতি করবে? ওকালতি করলে কিন্ত এক সাথে, কাছাকাছি, পাশাপাশি অনেকটা পথ হাঁটার সুযোগ থাকবে না! মালিহার মুখে তখন লাজুক এক চিলতে হাসি।