:: তাহসিন আহমেদ ::
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়।
পাকিস্তানের উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের পূর্বেই তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। তৃতীয় যে শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ, যিনি মিট্টি মাসুদ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান।
পাকিস্তানী লেখক ও গবেষক নাসিম ইউসুফের বইতে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।
এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ (মিট্টি মাসুদ)
ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশের ওপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছিলেন তাতে এয়ার কমোডর জাফর মাসুদ অসন্তুষ্ট ছিলেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলে প্রেসিদেন্ট হাউসে মাসুদ ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে জাফর মাসুদ প্রেসিডেন্টের কাছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেন।
২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর জাফর মাসুদ মারা যাওয়ার পর তাঁকে স্মরণ করে ডন পত্রিকায় ১৩ অক্টোবর ২০০৬ সালে পাকিস্তানের সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল জামাল খান লিখেছেন, মিট্টি মাসুদ ছিলেন বিমানবাহিনীর এক সাহসী কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি তাঁর কমান্ডকে নিরীহ মানুষ হত্যার কাজে ব্যবহার করতে দেননি।
জাফর মাসুদ শেষে চেষ্টা হিসেবে খুনি ইয়াহিয়া খানকে বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর সময়ও তাঁকে এর পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা এবং বাঙালিদের ওপর গণহত্যা এড়ানোর জন্য টিক্কার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ মার্চ মাসুদ এয়ার কমোডর ইনামুল হককে (পরবর্তীকালে এয়ার মার্শাল) বিমানবাহিনীর কমান্ডের দায়িত্ব দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তাঁকে নতুন পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও মাসুদ তা গ্রহণ করেননি এবং বিমানবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম জাফর মাসুদের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি।
নাসিম ইউসুফের বইতে শেষ মন্তব্য ছিল ‘মাসুদের বীরত্বপূর্ণ ও নীতিগত অবস্থান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর সম্ভাবনাময় পেশা ত্যাগ করেছেন জনগণের অধিকার এবং দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য।’
লেফটেনেন্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান
লেফটেনেন্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সামরিক দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি সরকারেও দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর ছিলেন। জেনারেল জিয়াউল হকের অধীনে তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি কূটনৈতিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৮২ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘে পশ্চিম সাহারার প্রতিনিধি ছিলেন।
ইয়াকুব খান ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ইসলামাবাদে মৃত্যুবরণ করেন।
ভাইস-এডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান
ভাইস-এডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান পাকিস্তানের ৪র্থ নৌবাহিনী প্রধান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের নৌ গোয়েন্দা বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন। পাশাপাশি নৌবাহিনীকে আধুনিক করায় আর ভূমিকা ছিল। নৌ গোয়েন্দা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে তিনি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় নৌ গোয়েন্দাদের অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৩৮ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটেনে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। আরাকানে সংঘটিত একটি নৌযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি ডিস্টিঙ্গুইশড সার্ভিস ক্রস খেতাব পান। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের লিভারপুলের একটি টেকনিকাল স্কুলের ইন্সট্রাক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এডিসি ছিলেন।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর এডিসি হন।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের নৌবাহিনীর এটাশে ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি রিয়ার এডমিরাল হন। ১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি নৌবাহিনীর প্রধান হন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে তিনি ভাইস এডমিরাল পদে উন্নীত হন।
১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করার পর ১ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেন। তিনি গভর্নরের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কালক্ষেপণের ফলে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণ বিক্ষোভ দেখা দেয়।
১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মুহাম্মদ আহসানের স্থলে সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়।
সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান ১৯৫৮ সালে সিতারা-ই-কায়েদে আজম, ১৯৬৯ সালে সিতারা-ই-পাকিস্তান এবং হিলাল-ই-কায়েদে আজম খেতাব লাভ করেন।
তিনি ৪ ডিসেম্বর ১৯৮৯ তারিখে ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।